“নির্বাণ”
“নির্বাণ”
২৬তম সংঘনায়ক দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাথের
২৬তম সংঘনায়ক দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাথের
ভগবান গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত মতবাদ আমাদের কাছে বৌদ্ধ ধর্ম নামে পরিচিত। সাধারণ ধর্ম বলতে যে সংজ্ঞা বা সংস্কার আমাদের মনকে অভিভূত করে এই মতবাদ আসলে ধর্ম নয়, ধর্ম থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পন্থা। প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম অর্থে এই স্বভাব বা সংস্কার বিজ্ঞান বা অভিজ্ঞতা সৃষ্টির মাধ্যমে সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় সহয়তা করে মানুষ সমাজকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে সাধারণত কোন সার্বভৌম শক্তির এখতিয়ার বলে মনে করা হয়। এই মতবাদ পৃথিবী সাধারণত একটি সার্বভৌম শক্তির অধীনে পরিচালিত বলে প্রচলিত ধর্ম সমূহ বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসে যে ধর্মগুলিকে সৃষ্টি করা হয় তা হচ্ছে স্বর্গলাভ। এই ধারণার পেছনে ভোগের প্রক্রিয়াকে স্থিতিশীল বলে ধারণা করা হয়। স্মৃতি আয়ুবোধে সাধারণত প্রাণী জগত পরিচালিত। তার জন্ম মৃত্যু কালসীমার স্তিমিত। এই সীমাকে অতিক্রম করে ভোগ সুখের পার্থিব জগতে স্থায়ী রূপ নেই। এই কারণে স্বর্গকে মানুষের লক্ষ্যে আনা হয়। প্রাণী জগৎ একত্রিশটি লোক সংস্কৃতিতে বিভক্ত। বিভাগগুলোর মধ্যে হচ্ছে, চারিটি অরূপ ব্রহ্ম, ষোল প্রকার রূপ ব্রহ্ম, সপ্তকাম সুগতি ভূমি, চারি অপায়। চারি অপায় বলতে নিরয়, প্রেত, তির্যক ও অসুর ভূমি, এই চারি অপায়ের ভিতর তির্যক ভূমি আমাদের দৃষ্টি সীমার ভেতর আছে। এই সম্পর্কে আমরা অতি নিকট থেকে অবগত হই অপর তিনটি প্রাণীর সংস্থা সাধারণের সৃষ্টির বাইরে। সপ্ত কাম সুগতির মধ্যে আমাদের মনুষ্যলোক একটি। অথবা মানুষেরা বিভক্ত একটি হচ্ছে পুরুষ অপরটি হচ্ছে নারী। এই দুই শক্তির সম্মিলিত শক্তিই সংসার নামে অভিহিত। এই দুই শক্তিকে কেন্দ্র করে সংসারে নানা অশান্তি এবং শান্তির ধারা অবিরাম গতিতে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহ চির চঞ্চল এবং গতি সম্পন্ন। স্থিতিশীলতার কোন চিহ্ন এতে নেই। এই পটভূমিকায় বিভিন্ন ধর্মের কল্পনা করা হয়। এই কল্পনার ভিতর বাস্তবের কোন অস্তিত্ব নেই। অপর ছয়টি কাম সুগতি দেবলোক নামে অভিহিত। এখানে ভোগ সুখের নিরাপত্তা আছে কিন্তু স্থায়ীত্ব গতিশীলতার কারণে এই ছয় কাম সুগতি জন্ম মৃত্যুর কালসীমায় সীষিত ষোল প্রকার রূপ ভূমি কাম সুখের অন্তর্ভুক্ত নয়। ঐখানে নর ও নারী রূপে কোন পৃথক সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই। এই কারণে সম্পদের ও প্রযোজনীয়তা নেই। এই প্রাণী লোকের ধর্ম হচ্ছে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা। সর্ব জীবের কল্যাণ ব্রতে এরা নিবেদিত প্রাণ। কিন্তু প্রাণী জগতে গতিশীলতার কারণে এরাও জন্ম মৃত্যুর অধীনে। চারি প্রকার অরূপ ভূমির দৈহিক জীবনের কোন অস্থিত্ব নেই। কিন্তু প্রকৃতির কারণে সুনির্দিষ্ট কাল পরে এরাও মৃত্যু মুখে পতিত হয়। নতুন জীবন ধারণের মাধ্যমে তাদেরও শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।
যেহেতু আমাদের প্রাকৃতিক জগৎ ভোগও ধর্ম সমন্বয়ে গঠিত যেহেতু তাদের সার্বিক জীবন ধারায় জন্ম মৃত্যুর সীমায় সীমিত। আমাদের সভ্যতার চিকিৎসা বিজ্ঞান জরা ব্যাধি মৃত্যুর গতিরোধ করার সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। কিন্তু আজকের তারিখ পর্যন্ত এর কোন সমাধান দিতে পারেনি। প্রাণী স্থানে জন্ম গ্রহণ করে কাল তাকে গ্রাস করে। পৃথিবীর একদিকে জীবন অন্যদিকে জন্ম জরা ব্যাধি মৃত্যু। দুই ধারা হচ্ছে জীবন ধর্মের বাস্তব রূপ জীবন যেহেতু সমবায়কৃত সেহেতু সমবায়ে বিলোপে তার ভিতর জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু প্রবিষ্ট হয়। ভগবান গৌতম এই ধারাকে রোধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বুদ্ধের জীবনকে আমরা তিন ভাগে করে দেখি এক ভাগ হচ্ছে প্রস্তুতিপর্ব, দ্বিতীয় অধ্যায় হচ্ছে প্রস্তুতি অবস্থা, তৃতীয় অধ্যায় হচ্ছে সমাপ্তি অবস্থা বা ফল অবস্থা। আমরা বুদ্ধ জীবন সমাপ্তি দিক দিয়েই বুদ্ধকে ভগবান চেষ্টা করে এসেছি, তার ফলে অন্যান্য ধর্ম প্রর্বতকের ন্যায় তাকেও একজন ধর্ম প্রবর্তক হিসাবে অভিহিত করে এসেছি। কিন্তু তিনি ধর্ম প্রবর্তক নন তিনি প্রবর্তন করেছেন ধর্মচক্র। যে ধর্মচক্র জীবনকে জীবকে পরিচালিত করে আসছে এখানে নির্বাণ শব্দটি আমাদের নিকট বিশেষ তাৎপর্য বহন করে আসছে। এই নির্বাণ হচ্ছে জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর অবসান। মৃত্যুর দ্বারা একটি জীবনের সৃষ্টি হচ্ছে তা আমরা অনব্রত দেখে আসছি। কোন বিশেষ শক্তি সমূহের অবসানের ফলে যে নতুন শক্তির উদ্ভব হয় তা আমরা অনব্রত অনুভব করছি। যে শক্তি সমূহের দ্বারা আমাদের জীবনের সুখ পরিচালিত তা অনব্রত মৃত্যুর ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়। যেমন দুধের বিয়োগে দধির সৃষ্টি হয়। জলশক্তি ভিন্নখাতে প্রবাহিত হবার ফলে জল বিদ্যুতের উদ্ভব হয়। এই বিদ্যুৎ বিভিন্ন শক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে জন সাধারণের অনেক উপকার হচ্ছে। আজ কালকার যুগকে আমরা সাধারণত বৈজ্ঞানিক যুগ নামে অভিহিত করে আসছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বা বিজ্ঞান সাধারণ বস্তুর নির্ভর। এ কারণে বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা অমানবিক যুগে প্রবেশ করেছি। বিজ্ঞানের সৃষ্টি শক্তি ও ধ্বংস শক্তির সম্পর্কে এখন আমরা ক্রমান্বয়ে সচেতন হয়ে এসেছি। বিজ্ঞান সুখ ও শান্তি সৃষ্টির যেমন সহায়তা করছে অসুখ ও অশান্তি সৃষ্টির পেছনে তার প্রভাব ও আকার আমরা ক্রমে উপলব্ধি করে এখন শক্তির অন্বেষায় বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এই প্রচেষ্টা সত্যিকারভাবে কখনো যে সফল হবে এই আশা মোটই করতে পারিনা। বস্তু বিজ্ঞানের সাথে আমরা এখন মনোবিজ্ঞান শব্দটি প্রয়োগ করছি। কিন্তু বস্তু বিজ্ঞানে যে মনোবিজ্ঞানে বহিঃরূপ একথা এখনো স্বীকার করতে পারছি না।
তথা কথিত বৈজ্ঞানিক যুগকে কেন্দ্র করে আজকের জীবন পরিপূর্ণ ও অস্থিতিশীলতা এসে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ কারণে ভগবান গৌতম বুদ্ধের মতবাদ আমাদের আলোচনার ভিতরে আনতে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন জন্ম দুঃখ, তদ্রুপ জরা, ব্যাধি, মৃত্যুও দুঃখ। এর থেকে যদি মুক্তি পেতে হয় একে বন্ধন শূন্য করতে হবে। জন্মের সঙ্গে জরা ব্যাধি এবং মৃত্যুর সঙ্গে জন্মের প্রবাহগত যোগ রয়েছে। নির্বাণ অথবা অবসান অবশ্যই করতে হবে। কি করে করা যায় এই নিয়ে তার চিন্তা এসেছিল বহুকাল পূর্বে। মনীষী নিউটন যেমন আপেল ফলের পতনকে কেন্দ্র করে জগতের মধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেছিলেন, সিদ্ধার্থ গৌতমও তেমনি জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এর আওতা থেকে মুক্তির জন্য উপায় অন্বেষণের কথা ভাবছিলেন। এই তার জীবনের শুরু। তিনি এই পথ অবিষ্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ নিলেন। “দীপঙ্কর বুদ্ধের” কাছ থেকে তারপর থেকে তার বোধিসত্ত্ব জীবন আরম্ভ হয়। এই জীবন চর্চার দশ পারমীকে পথ আবিষ্কারের উপায় হিসাবে গ্রহণ করলেন, এই বিষয় গুলো হচ্ছে দান, শীল, নৈষ্ক্রর্ম, প্রজ্ঞা, বীর্য, ক্ষান্তি, সত্য, অধিষ্ঠান, মৈত্রী ও উপেক্ষা। এই দশটি বিষয়কে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হলো পারমী, উপপারমী ও পরমার্থ পারমী। বাহ্যিক বিষয় সমূহকে কেন্দ্র করে যে অনুশীলন তিনি করলেন তা পারমী নামে অভিহিত, জীবনকে কেন্দ্র করে তিনি যে অনুশীলন করলেন তা উপ-পারমী নামে অভিহিত এবং স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে কেন্দ্র করে যে অনুশীলন করা হয় তা পরমার্থ পারমী নামে অভিহিত করা হয়। সম্পত্তি জীবন ও স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সাধারণতঃ জগত ও জীবন। একে কেন্দ্র করেই সভ্যতার যাবতীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধার্থ গৌতম এই তিনটির বিনিময়ে পূর্ব উক্ত দশটি বিষয়কে জীবনের ভেতর প্রতিষ্ঠিত করলেন। এই প্রস্তুতি পর্ব বা বোধিসত্ত্ব জীবন অসংখ্যা কাল সীমার সীমিত কপিল বস্তুর জীবন ধারা হচ্ছে এর পরিপূর্ণ বিকশিত রূপ যার ফলে তাঁর দৈহিক রূপ বত্রিশ লক্ষণ ও অশীতি অনুব্যঞ্জনে সীমিত এই মহান পুরুষ শ্রেষ্ঠ বৈশাখী পূর্ণিমায় ঐ শক্তি বলে কর্মের সম্পূর্ণ নিভৃতি করলেন অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে কর্মের নিরোধ ঘটালেন। যা জগতে “ক্লেশ নির্বাণ” বা বুদ্ধত্ব লাভ নামে অভিহিত। বুদ্ধত্ব লাভের পর কুশিনগর শাল বৃক্ষ তলে বিপাক বা ফলের তিনি নিভৃতি ঘটালেন যা আমাদের কাছে “স্বন্ধনির্বাণ” বা “পরিনিবার্ণ” নামে অভিহিত। জীবনের দুইটি দ্বারা একটি হচ্ছে জন্ম বা বিপাক রাশি। যা কর্ম সৃষ্টি করে। বিপাক বা ফল দিয়ে আমরা যে কর্মের সৃষ্টি করি তা আমাদের জন্মান্তরের বা ভিন্ন শক্তিতে রুপান্তরে সহায়তা করে। এই আমরা জীবনের ভেতর দিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুভব করি কিন্তু এই সম্পর্কে আমাদের যথার্থ উপলব্ধির অভাবে সঠিক ধারণা করতে পারিনা।
সুতরাং যথার্থ মুক্তি বা শান্তি যদি আমাদের কাম্য হয় কর্মের অবসান করতেই হবে। কর্ম নিরোধের মাধ্যমে আমরা বিপাককে নিরোধ করতে পারবো। এতদ উভয়ের নিরোধকেই “নির্বাণ” নামে অভিহিত করা হয়।
প্রবন্ধটি : নির্বাণ পত্রিকা বৈশাখী পূর্ণিমা সংখ্যা-১৯৮৭ মে ১২ হতে সংগৃহিত
0 comments: