সমালোচনা

                       
সমালোচনা
সমালোচনা কথাটি আাকারে ছোট কিংবা বলতে কম সময় লাগলে ও এর বিশালত্ব কিন্তু কম নয়। সমালোচনাকে যদি আমরা সন্ধি বিচ্ছেদ করি তাহলে দাড়ায় সম+আলোচনা=সমালোচনা। আর একে আবিধানিক অর্থ দ্বারা বিশ্লেষন করলে হয়, ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রদর্শন পূর্বক আলোচনা। অর্থাৎ কারো দোষ বা ভুল সচক্ষে দেখে আলোচনা করাকে বুঝায়। আবার এটাও ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সাহিত্য বা শিল্পের দোষ-গুনের উপর সভ্য আলোচনা। যাইহোক, কয়েকজন মানুষ যখন একত্রে মিলিত হয়ে কোন একটি বিষয়ে আলোচনা করে তখনকতাড় সেটা সমালোচনার পর্যায় পড়ে না, কারণ সেখানে কোন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আলোচনা করা হচ্ছে না। কিন্তু যখন কোন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন সেটা সমালোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। আবার সেই আলোচনা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি জনসমক্ষে বা বৃহত্তর মধ্যে প্রকাশ করা হয় তাহলে তা আর ও বেশি বিরাট আকার ধারণ করে। এখন কথা হচ্ছে আলোচনা বা সমালোচনা এ দুয়ের মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা যতটুকু সমালোচনা করতে অভ্যস্ত,  ততটুকু আলোচনা করতে অভ্যস্ত নই। আবার এটা ও সত্য যে, আমরা নিজেকে নিয়ে যতটুকু না সমালোচনা করি, অপরকে নিয়ে তার চাইতে বেশি সমালোচনা করি। যদি প্রশ্ন করা হয় এত সমালোচনা কেন, এর কারনই বা কি? এর সহজ উত্তর দাঁড়াবে, সকল প্রানীর মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না এমন কি নিজের স্বার্থের জন্য হীন কাজ করতে দ্বিধা বোধ করে না। যেখানে গর্হিত কাজ করতে বিবেক বাঁধেনা সেখানে সমালোচনা করতে দ্বিধা কোথায়! এক কথায় স্বার্থের তাড়নায় সমালোচনা করা হয়। তাই অপরে কি করছে না করছে সেদিকে লক্ষ্য না রেখে আমি নিজে কি করছি তা লক্ষ্য করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে নিজের দোষ কিংবা ভুল গুলো খতিয়ে না দেখে অপরকে নিয়ে খোঁচাখোচি করছি, আমরা যখন অন্যের সমালোচনা করি, তখন কি একবারও নিজের বিবেককে করার প্রয়োজনবোধ মনে  করি না। কিন্তু যারা প্রকৃত মানুষ এবং জ্ঞানী তারা প্রশ্ন রাখেন বলে মনে হয়, কারণ তারা সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন অপরকে নিয়ে নয় যদিও বা কোন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সমালোচনা করে থাকে তাও সে তার সম জ্ঞানী ব্যক্তির উদ্দেশ্যে করবে এবং ঐ জ্ঞানী ব্যক্তিও তার জ্ঞান দ্বারা পাল্টা জবাব দেবে এটাই হচ্ছে জ্ঞানী লোকের সমালোচনা। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, তারা সমালোচনা করে কোন হীন স¦ার্থের জন্য নয় বরং জ্ঞান আহরনের জন্য।
সুতরাং আমরা যারা সমালোচক ( যিনি বা যারা আলোচনা করেন তিনি সমালোচক) আছি প্রকৃত অর্থে কিন্তু আমরা মানুষ ও নই আবার জ্ঞানী ও নই, শুধু মানুষের অবয়ব ও জ্ঞানীর বেশ ধারণ করে আছি মাত্র। তাইতো যত্রতত্র অন্যের সমালোচনা করি এমন কি স্থান, কাল, পাত্র পর্যন্ত বিবেচনা করিনা। বর্তমানে শুধু নিজেকে জ্ঞানী বলে জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য, অনিত্বকে বড় করার মানসে এবং হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি আর সমালোচনা করি অন্যের। চিন্তা করিনা যে, কেন আমাদেরকে মানুষ বলা হয়, কেন প্রাণীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই কথাটি সঠিক জ্ঞান দিয়ে যদি বিবেচনা না করি তাহলে আমি যে মানুষ হয়তো তাও একদিন ভুলে যাবার সম্ভাবনা আছে।
সুতরাং মানবীয় গুণ, বুঝার ক্ষমতা, আত্মসম্মানবোধ আছেই বলেই আমরা মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাজার সাধনার পরে যে মানবীয় গুন অর্জন করি , তিল তিল করে যে আয়ত্বে এনেছি সে সব ধুলোয় মিশিয়ে দিই আরও বেশি স্বার্থের জন্য।
কথায় বলে একটা পাকা দালান তৈরি করতে এক বছর কিংবা তার ও বেশি সময় লাগে কিন্তু সেটি ভাঙতে খুব কম সময়ের প্রয়োজন হয়। ঠিক তদ্রুপভাবে মানুষের গুনাবলির বেলায় তাই। কি হবে মিছে মরিচিকার পিছনে ছুটে একদিন তো সবাইকে পারাপারের দ্বার গ্রহন করতে হবে তাহলে কেন এতো স্বার্থের জন্য আহাজারি। কেন সত্যকে মিথ্যার চাদরে ঢাকিয়ে এতো সমালোচনা। সত্য সেতো সবসময় সত্য, সেটাকে কখনও মিথ্যার চাদরে লুকিয়ে রাখা যায় না। যেমন করে ইতিহাস বিকৃত করা যায় না। যতই ডাক-ঢোল পিটিয়ে সমালোচনা করা হোক না কেন, সত্য একদিন বেড়িয়ে আসবেই। আর সত্য যখন বেড়িয়ে আসবে তখন কিন্তু ঠিকে থাকা অধিক কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। কারন পৃথিবীর মধেব এমন কোন সত্য বিদ্যমান নেই বা মিথ্যার আশ্রয়ে প্রকাশ পায়নি। ভবিষ্যতেও পাবে। তাই প্রত্যেক সমালোচকের উচিত কারো সমালোচনা করার আগে নিজে কতটুকু সত্য পথে আছেন এবং শুদ্ধতার সহিত জীবন যাপন করেছেন তা বিচার করা। কারণ নিজে যদি গোপনে অনৈতিক কাজ করেন আর নিছক মুর্খতা ছাড়া আর কি হতে পারে। হোক সে প্রাতিষ্ঠানিক দিক দিয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী। সে যদি এ পথের পথিক হতে চায় তাহলে কার কি করার আছে। আমার মনে হয় যারা সমালোচনা করে তারা প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু একটু চিন্তা করিনা যে, এই প্রতি হিংসাই মানব সমাজের অবক্ষয়ের কারন এবং অগ্রযাত্রার অন্তরায়। আবার  আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, কেই সমালোচনা করে তাদের পূর্বপুরুষ কর্তৃক পাওয়া অভ্যাস থেকে। তারা মনে করে আমাদের পূর্ব পুরুষরা করে এসেছে আমরা ও করব কারন উত্তরসুরী হিসেবে আছি বলে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে চলে আসছে, এর শেষ কোথায় আদৌ বলা কঠিন। আর এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে মানব জাতির পথ প্রদর্শক হয়ে পূজা , অর্চনা নেওয়া মানে হয় না। প্রত্যেকে চায় একটি সুন্দর জাতিও সমাজ যেখানে সুস্থভাবে বসবাস করতে পারবে এবন জীবনকে কল্যানের পথে পরিচালিত করতে পারবে। কিন্তু মানুষের জীবনে কল্যানের চেয়ে অকল্যাণই বেশি বয়ে আনে এই সমালোচনা। আমরা অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই আমাদের সমাজ ভঙ্গুর কিংবা পঙ্গু হবার পিছনে দায়ী কিন্তু এই সমালোচনা কিংবা পর নিন্দা। যদিও বা মনে করি যে, নিজের দোষ-ত্রুটিগুলি চেপে রেখে কিংবা অন্যের ঘাড়ে চেপে দিয়ে এবং অপরের সমালোচনা করে জয়ী হয়েছি কিংবা হতে যাচ্ছি তাহলে মনে রাখা প্রয়োজন যে, কোনটি স্থায়ী জয় আর কোনটি অস্থায়ী জয়।
অতএব আমাদের সুযোগ্য সমালোচকবৃন্দগণ ঐগুলি নিয়ে মাথা ঘামান না মাথা ঘামার অবকাশ পাননা জানি না। কিভাবে পাবে তারা তো ব্যস্ত অন্যের সমালোচনা করে, নিজের হীন স্বার্থ হাসিল করা এবং পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রক্ষা করা। তারা বোঝেনা যে, নিজেদের হীন স্বার্থের জন্য মানব জাতির ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে এবং প্রকৃত আলোর সন্ধান না দিয়ে অন্ধকারে যাওয়ার জন্য উৎসাহ যোগান দিচ্ছে। সুতরাং হীন স্বার্থ পরিত্যাগ করে একটি সুন্দর, সুস্থ মানব জাতি তথা সমাজ উপহার দেওয়া সকলের উচিত বলে মনে করি।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক
[ বি:দ্র: আমার এ লেখা কারোর প্রতি আক্রোশবশত নয় বরং বর্তমান সময়ে সমাজে যে সমালোচনার ঝড় বইছে এবং সমাজ যে অবক্ষয় হচ্ছে তাকে নিয়ে]


লেখক সুমনানন্দ ভিক্ষু
অধ্যক্ষ কাঁঠাল ভাঙ্গা সর্বজনীন বৌদ্ধ বিহার।

0 comments: