বৌদ্ধ ধর্মে মার দর্শন

বৌদ্ধ ধর্মে মার দর্শন

     --------ভদন্ত দেবপ্রিয় ভিক্ষু।

বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনে চিরশান্তিময় নির্বান লাভের জন্য সাধনার পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী মারের প্রভাব ও অলৌকিক ক্ষমতার কথা পবিত্র ত্রিপিটক গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ আছে। বিভিন্ন কারণে ও বিভিন্ন স্থানে মার বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। মারের অপর নাম বসবর্তী অন্তকো পমত্তবন্ধু, মারো পাপিমা, শয়তান ইত্যাদি।

যারা কুশলিয় কর্ম করেন, বিমুক্তি সাধনায় রত তাঁরা কুশলে কর্ম সম্পাদনের মধ্য দিয়ে অকুশল ভাবকে তিরোহিত করতে সচেষ্ট।  মার তার প্রভাবের বাইকে যাতে সাধকগণ যেতে না পারে, সে জন্য সাধকের সাধনার পথে বাধা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সময়ে মার তার প্রভাবের দ্বারা সাধককে প্রভাবিত করে। যে সাধক দৃড়চেতা, বীর্যবান মার কোন ক্রমেই তাঁদেরকে প্রভাবিত করতে পারে না। সংসার জীবনে যেরূপ দেখা যায়, অনেক দুষ্ট প্রকৃতির লোক সৎ ব্যক্তিদেরকে বিপথগামী করে, তেমনি মারও সাধক ব্যক্তিদেরকে কৃ-পথে ধাবিত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

* মারের প্রকারভেদ ঃ
পবিত্র ত্রিপিটকে পাঁচ প্রকার মারের কথা উল্লেখ আছে- যথা
ক) স্কন্ধ মার
খ) মৃত্যু মার।
গ) ক্লেশ মার।
ঘ) অভিসংস্কার মার।
ঙ) দেবপুত্র মার।
ক) স্কন্ধ মার ঃ রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে পঞ্চ স্কন্ধ বলা হয়। ইহা নাম-রূ, এই জন্মে শীল ভঙ্গের কারণে কতগুলি কায়িক-বাচনিক ও মানসিক কু-অভ্যাস রপ্ত হয়ে থাকে। যেমন-বাজে কথা বলা, হাত-পা অথবা মাথা দোলাতে দোলাতে কথা বলা, চঞ্চল স্বভাবের কারণে নানা অঙ্গ-ভঙ্গি ব্যক্ত করা, ঢেকুর তোলা, শারীরিক ব্যধি, খিটখিটে মেজাজ, বদরাগী, হিংসুটে ভাব, ইর্ষাপরায়নতা-মাৎসর্যভাব ইত্যাদি প্রকাশ পায়। অনেকে আবার পূর্ণময় কাজের দ্বারা কায়-বাক্য, মনের দ্বারা সৎকাজ, পুষ্প পূজা, প্রদীপ পূজা ইত্যাদি করেন থাকেন। স্মৃতি ভাবনার সময় উপরোক্ত দূষণ স্বভাব ও সৎ-স্বভাবগুলি কায় বাক্য এবং মনে বিকাশ লাভ করে প্রতিবন্ধক হয়ে পড়ে এজন্য এগুলিকে স্কন্ধ মার বলা হয়েছে।

খ) মৃত্যু মার ঃ ‘‘জাতস্য হি ব্রবোমৃত্যু  জাতের মৃত্যু ধ্র“ব সত্য। মৃত্যু বলতে সত্ত্বগণের বর্তমান দেহের নাম ও রূপ স্কন্ধের চ্যুতি। চবনতা, অর্ন্তধান, কালক্রিয়া বা কালনিক্ষেপ বুঝায়। পঞ্চ স্কন্ধ বা পঞ্চভৌতিক দেহের পতন অবশ্যম্ভাবী। সকল জীব মাত্রই মৃত্যুর অধীন বলে জন্ম ধারণ দুঃখজনক। জন্ম হলে মৃত্যু হবে। কেউ মৃত্যু পথকে রোধ করতে পারবে না। মৃত্যু রূপ মার যতকাল পর্যন্ত মানুষ নির্বাণ রাজ্যে প্রবেশ না করে, ততকাল পর্যন্ত মানুষকে গ্রাস করে থাকে। সেজন্য মৃত্যুমার যাতে সাধকগণ তার ক্ষমতার বাহিরে গিয়ে নির্বাণ লাভ করতে না পারে সেজন্য কু-পথে পরিচালনা করতে সচেষ্ট থাকে।

গ) ক্লেশ মার ঃ ক্লেশ শব্দের অর্থ হল চিত্তের কালিমা। চিত্ত সর্বদাই স্বচ্ছ আয়নার ন্যায় নির্মল। স্বচ্ছ আয়নারয় যেরূপ ধূলা বালি দ্বারা আচ্ছ্ন্ হলে প্রকৃত প্রতিবিম্ব অপ্রচ্ছন্ন হয় তেমনি লোভ-দ্বেষ-মোহ রূপ আয়না দ্বারা প্রচ্ছন্ন চিত্ত ক্লেশ মার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়। অভিধর্মে উননব্বই প্রকার চিত্তকে কামাবচর, রূপাবচর, অরূপাবচর ও লোকোত্তর ভেদে চার ভাগে বিভক্ত করপা হয়েছে। এ ঊননব্বই প্রচার চিত্ত বায়ান্ন প্রকার চৈত্তসিক ধর্মের সংস্পর্শে এসে প্রতিক্ষনেই ক্লেশ মার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়। ক্লেশের প্রভাবে পৃথকগণ বিভ্রান্ত হয়ে নানা প্রকার পাপকর্মে লিপ্ত হয়। এহেতু তারা হই জীবনেই মহাদুঃখ ভোগ করে। মৃত্যুর পর নরক তির্যক, প্রেত ও অসুর ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করে অনন্তকাল ধরে অপায় দুঃখ ভোগ করে। আবার কেউ সুগতি ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করলেও ক্লেশ মারের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে চির শান্তিময় নির্বাণ লাভ হতে বঞ্চিত হয়।

ঘ) অভিসংস্কার মার ঃ- অভিসংস্কার মার ভোগ চেতনা মার নামে পরিচিত। অভিসংসার তিন ভাগে বিভক্ত। যথা-
১। পুঞঞাভি সংস্কার।
২। অপুঞঞাভি সংস্কার
৩। আনেঞ্জাভি সংস্কার সংস্কাার জন্মের হেতু সৃষ্টিকারী। অভি সংস্কার বলতে ইহ জন্মের সংস্কার ছাড়া ও অতীত অতীত জন্মের অতিরিক্ত সংস্কার এই গুলি বোঝায়?

প্রসঙ্গত ঃ এক সময় একজন শ্রেষ্ঠী ভগবান বুদ্ধের নিকট ক্ষীনাস্রব ভিক্ষুদের আমন্ত্রন করতে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধ শ্রেষ্ঠীকে নির্দিষ্ট ভিক্ষু প্রবরদের নিমন্ত্রন করতে বললেন। শ্রেষ্ঠ তাঁদের নিকট গিয়ে দেখতে পেলেন যে, কোন কোন ভিক্ষু মাটিতে আঁচর কাটছেন। কেউ বা গাছের ডাল দোলাচ্ছেন আবার কেউ বা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। এতে শ্রেষ্ঠীর মনে ভিক্ষুগণ ক্ষীনাস্রব কিনা সন্দেহের সঞ্চার হয়। বৃদ্ধ শ্রেষ্ঠীর অবস্থা বুঝে বললেন-উক্ত ভিক্ষু ক্ষীনাস্রব পূর্ব জন্মের তাঁরা কেউ বা নক্ষত্রবিদ, কেউ বা বানর, আবার কেউ বা কেঁচো ছিলেন বলে সংস্কার বশে সেরূপ স্বভাব ব্যক্ত করছিলেন। প্রকৃত পক্ষে তাঁরা সবাই অরহত।

ঙ) দেবপুত্র মার ঃ দেবপুত্র পরিনির্মিত বশবর্তী দেবলোকে বাস করে। এ দেবপুত্র মার অলৌকিক শক্তির দ্বারা বিভিন্ন  রূপ ধ্বংস করে। কোন সত্ত্বই যাতে কামলোকের উর্ধ্বে যেতে না পারে সেজন্য তার অকুশল শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। এ দেবপুত্র মার যাতে সত্ত্বগণ কামলোকের নাগালের বাইরে গিয়ে নির্বাণ লাভ করতে না পারে সেই জন্য সে চির প্রতিদ্বন্ধী রূপে সাধকদের সাধনার পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে।

সিদ্ধার্থ যখন বজ্রাসনে বসে বজ্রাধিষ্ঠান করে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হন, তখন দেবপুত্র মার গিরিমেখলা হস্তিরাজের পৃষ্ঠে আরোহন করে সহস্র সৈন্য নিয়ে তাঁকে আক্রমন করেছিলেন। সারারাত ভীষণ সংগ্রাম চালিয়ে সিদ্ধার্থ এক চূল প্রমাণ স্থানও চ্যূত করতে পারেননি। দান ও ধর্মের প্রভাবে সিদ্ধার্থ সসৈন্য মার রাজাকে পরাভূত করে দূলর্ভ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন।
এ দেবপুত্র মার সম্রাট অশোকের ৮৪০০০ হাজার চৈত্য উৎসর্গের সময় প্রবল শিলাবৃষ্টি ও ঝড় সৃষ্টি করে। তখন অর্হৎ ভিক্ষুগণ বুঝতে পারলেন এবং মার দমনের জন্য অর্হৎ উপগুপ্তকে নির্বাচন করলেন। উপগুপ্ত ও বিভিন্ন প্রকার ঋদ্ধির সাহায্যে মারের উপদ্রব বন্ধ করেছিলেন। অর্হৎ উপগুপ্ত চিন্তা করলেন এ দেবপুত্র মার অত্যন্ত ধূর্ত। তাকে সম্পূর্ণরূপে দমন করতে না পারলে ধর্ম সংগীতিতে বিভিন্ন অন্তরায় ও বাধা সৃষ্টি করবে। তখন অর্হৎ উপগুপ্ত ঋদ্ধি শক্তির প্রভাবে মারকে বন্দি করে গলা একটা পঁচা কুকুর বেঁধে পাহাড়ের গুহায় ফেলে রাখেন। তখন মার অত্যন্ত দুঃখ করে বলল আমি সম্যক সম্বুদ্ধকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তবুও তিনি কোন দিন এরূপ কষ্ট দেননি। মানুষের আয়ু অপেক্ষা আমার আয়ু অনেক বেশি। অর্হৎ উপগুপ্তের মৃতে্যুর পর আমার প্রভাব সর্বত্র বি¯তৃত করব। অর্হৎ উপগুপ্ত মারের এরূপ দাম্ভিকতা শ্রবণ করে তিনি বুদ্ধের শাসনের আয়ুষ্কাল যতদিন থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সংকল্প করলেন। এদিকে নাগরাজ অর্হৎ উপগুপ্তের আয়ু বৃদ্ধির কথা জানতে পেরে তাঁকে নাগলোকে নিয়ে গেলেন। অর্হৎ উপগুপ্ত বর্তমানে নাগলোকে বাস করছেন।

উপসংহার ঃ এই পৃথিবীতে মানুষ ত্রিতাপে দগ্ধ হচ্ছে। ত্রিতাপে দগ্ধ হয়ে মানুষ জন্মান্তর  কাল ধরে দুঃখ ভোগ করছে। দুঃখ সাগরে নিমজ্জিত হয়ে মানুষ মুক্তির পথ খোঁজে পায় না। যাঁরা মুক্তির সন্ধানে সাধনার পথে অগ্রসর হচ্ছেন, মার তাঁদেরকে নিজ অধীনে আনার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। যাঁরা বীর্যবান নয় তাঁরা মারের প্রভাবে পড়ে সংসারের বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করে নিজেই নারকীয় দুঃখ ভোগে। তাই মারের প্রভাব হতে মুক্তি লাভ করতে হলে মানুষকে প্রজ্ঞাবান হতে হবে। স্বীয় বীর্য বলে মারের প্রভাবের গন্ডীর বাইরে গিয়ে জীবনকে সার্থক করতে হবে। অন্যথায় মানব জীবন লাভ বৃথাই পর্যবসিত হবে।
অতএব, আত্মশুদ্ধি ও আত্মমুক্তির জন্য মারের প্রভাব হতে নিজ নিজকে মুক্ত রাখার জন্য চেষ্টা করা সকলেরই কর্তব্য।


লেখকঃ সাধারণ সম্পাদক, পূর্বগুজরা বৌদ্ধ ভিক্ষু সম্মিলনী, সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভা।

0 comments: