“শান্তি চাই”

“শান্তি চাই”
মহামান্য মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভাণক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের


বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস নানা ঘটনা ও বিবর্তনের ইতিহাস। অগ্রগতি যেমন অভাবনীয় অবক্ষয়ও তেমনি অচিন্তনীয়। একদিকে দারুণ আনন্দ উল্লাস অন্যদিকে করুন হাহাকার। তাই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে অস্থিরতা। লোভ আর প্রতিহিংসার তীক্ষè জালে আবদ্ধ নর-নারী। পর-রাজ্য লোভ, আত্মপ্রতিষ্ঠা আর সম্পত্তির লোভ মানুষকে করেছে স্বার্থপর। এই অবস্থায় শান্তি নামক শব্দটি বহু দূরে নির্বাসিত। অথচ পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে শান্তি চাই। শান্তি কি সুদূর পরাহত? না, শান্তি অকল্পনীয় কোন বস্তু নহে। আজ বিশ্বে শান্তির জন্য হাহাকার উঠেছে। বিশ্বের সমগ্র মানুষ উঠেছে আধুনিক বিলাস ব্যাসনে আর যান্ত্রিক সভ্যতায় বন্দীদশায় এ সময়ে দরকার একটু স্বস্তি, একটু শান্তি। 
এই শান্তি কি ভাবে আসতে পারে। আমরা যারা ধর্মীয় আচার্যরা আছি আমাদের প্রত্যেকের এই ব্যাপারে একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে বলে মনে করি। এ যাবৎ সর্ব ধর্মের যত সম্মেলনে গেছি সর্বত্রই একটি কথা বলেছি যে আমাদের সকলের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। সকল ধর্মের মর্মবাণীগুলিকে সন্নিবেশিত করে তাকে মানব কল্যাণে উৎসাহিত করা দরকার। আমি আহ্বান জানিয়েছি সকল ধর্মের আচার্যদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে একই টেবিলে বসে আহার করার জন্য একই লক্ষ্য চিন্তা করার জন্য এবং একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করার জন্য, আমার বিশ্বাস সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তখনই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বিভিন্ন ধর্মের লোক স্ব-স্ব ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত বলে বেড়াচ্ছে নিজেরটায় শ্রেষ্ঠ ধর্ম তাই অপর ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা জাগছে না, সে অপর ধর্মালম্বীদের প্রতি সহনশীল হতে পারছে না। ক্রমাগত দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে এতদ্বারা ধর্মীয় রেষারেষি বাড়ছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। সেজন্য পরস্পরকে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে হবে প্রত্যেককে সকল ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে হবে। শিশুকে সকল ধর্মের প্রতি বাল্যকাল থেকে জ্ঞান দান করতে হবে। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন ধর্মের কল্যাণময় বাণীগুলি থাকা দরকার। এছাড়া বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক সম্পর্কেও পরিচিতি প্রয়োজন। এভাবে আমরা শিশুদের আগামীকালের উদাত্ত সহনশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে পারি। দুঃখের কথা পৃথিবীতে ধর্মযুদ্ধে যত মানুষ মারা যাচ্ছে ধর্মের রেষারেষিতে যত জীবন বিনষ্ট হচ্ছে যুদ্ধে তত জীবন বিনষ্ট হচ্ছে না। অথচ ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণে, বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায়। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের চিন্তাকে জাগ্রত করা প্রয়োজন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান যে যেই ধর্মালম্বী হোক না কেন আমাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণ। কোন ধর্মে হত্যা, চুরি, মিথ্যা, ব্যভিচার, মদ্যপান স্বীকৃত নহে, অতএব, আমরা যদি স্ব-স্ব ধর্মের বাণীগুলি পরিপূর্ণভাবে মেনে চলি তবে অশান্তির কোন কারণ থাকতে পারে না। বৌদ্ধ হিন্দু যদি হযরত মুহাম্মদকে, খৃষ্টান যদি কৃষ্ণকে, মুসলমান যদি বুদ্ধকে ভালবাসতে পারে, শ্রদ্ধা জানাতে পারে তবে আর ধর্মের জন্য যুদ্ধ হবে না। সাম্প্রদায়িক বাড়বে না। ধর্মে ধর্মে বিরোধ হবে না। মানুষ যদি প্রকৃতভাবে নিজের ধর্মের গুণাবলীগুলি বুঝতে পারে তবে সে অন্য ধর্মের প্রতি অসহনশীল হবে না এবং হতে পারে না। 
অতএব, আসুন আমরা একে অপরকে ভালবাসি। একে অপরকে গ্রহণ করি। এই ভালবাসা হউক শান্তির সুদূঢ় স্তম্ভ-এই গ্রহণ হোক লক্ষপ্রীতির ভিত্তি ভূমি। সেজন্য প্রত্যয়ের সাথে বলতে চাই। শান্তি প্রয়োজন এবং আমরা শান্তি চাই। এই কামনা হোক আমাদের অন্তরের এই প্রতিষ্ঠা হোক সর্বজনীন সাম্যের সত্যেরও শান্তির। 

সংগ্রহ : নির্বাণ পত্রিকা বৈশাখী পূর্ণিমা সংখ্যা-১২ মে ১৯৮৭ ইং।

0 comments: