বুদ্ধের বাণী অহিংসা পরম ধর্ম আজ কোন পথে

সর্বদর্শী ভগবান বুদ্ধ সুর্দীঘ পয়তাল্লিশ (৪৫) বছর ব্যাপি মানব সহ সকল প্রাণীর মঙ্গলের জন্য অমৃতময় বাণী প্্রচার করেছেন।সেসব বাণী গুলি যারা পালন করে জীবন যাপন করেন তারা বর্তমান জীবনে সুখ শান্তি লাভ করতে পারে এবং মৃত্যুর পর সুগতি প্রাপ্ত হয় । ভগবান বুদ্ধের অন্যতম বাণী হল অহিংসা পরম ধর্ম অর্থাৎ সকল জীব তথা সকল মানবের প্রতি সমভাবে মৈত্রী প্রদর্শন করা। হিংসা পরিহার করে অহিংসাময় জীবন যাপন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মা যেমন সন্তানের প্রতি অবিরত ভাবে অহিংসা পরায়ন থাকেন ঠিক সেরুপ ভাবে সকল জীব তথা মানবের প্রতি সকল মানব অহিংসা পরায়ন হলে সুন্দর পৃথিবীতে সুন্দর ভাবে মানবগন সুখে জীবন যাপন করতে পারবে। আজ আধুনিক বিশ্বে বুদ্ধের বাণী আহিংসা না থাকার কারণে মারা-মারি,যুদ্ধ,রক্তপাত সহ বিভিন্ন ভাবে মানুষের জীবন যাপন হয়ে উঠছে বিষাদময়।
অন্য ধর্মের অনুসারিদের কথা বাদ দিয়ে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিদের কথায় আসা যাক,যেহেতু আমরা নিজেরা নিজেদেরকে বৌদ্ধ বলে দাবি করি সেহেতু বুদ্ধের বাণী মেনে চলা আমাদের কর্তব্য । আসলে আমরা কি বুদ্ধের বাণী অহিংসা পরম ধর্ম বাণীটি মেনে চলি বা আমরা বিশ্বাস করি, যদি বিশ্বাস করি তবে আমাদেরকে হিংসা পরিহার করতে হবে। আমরা যারা বৌদ্ধ আমরা কি যথাযথ ভাবে বুদ্ধের বাণী অনুসরণ করছি। আমার মনে হয় আমি করছিনা, যদি আমিসহ আমরা সবাই বুদ্ধের বাণী অহিংসা পরম ধর্ম পালনে রত থাকতাম তবে আজ দেশে, সমাজে,বিহারে, সংগঠনে, নিকায়ে এত ভেদাভেদ কথা কাঁটা-কাটি, মামলা-মোর্কাদ্দমা হত না।

 গৃহী সমাজে বুদ্ধের অহিংসা নীতির প্রতিপালন:
গৃহীরা সংসার ধর্ম পালন করেন,সংসারে আনন্দ-উল্লাস,হাসি-কান্না,মান-অভিমান,সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়ে মানুষ জীবন যাপন করেন। বুদ্ধের ভাষায় মানব জীবন অতি দুর্লভ,অতীতের অনন্ত অনন্ত পূর্ণ রাশির প্রভাবে মানব জীবন লাভ করা যায়। অনেক বিজ্ঞ ব্যাক্তি বলেন মানব হল সৃষ্টির সেরা জীব। সমাজে জীবন যাপন কালে সমাজকে উন্নত করার জন্য এবং একতা বদ্ধ ভাবে সুখে জীবন যাপনের জন্য সামাজিক সংগঠন বা সমিতি স্থাপন করা হয়। নিজ ধর্ম আচরনের জন্য বিহার ও ভাবনাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সংগঠন মানে আমি যা বুঝি তা হল সকলে একত্রিত হয়ে সমাজের, দেশের ও সর্বসাধারনের মঙ্গল বা হিত সাধন করা। এখন আমাদের বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজে বৌদ্ধ সংগঠনের সংখ্যা বাংলাদেশের যত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় তার সমান। যদি সকল সংগঠন নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ি উন্নয়নমুলক কর্ম সম্পাদন করতেন তবে বাংলাদেশের বৌদ্ধরা আজ অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আসনে সমাসিন হতে পারতেন। অহিংসা নীতি যথাযথ ভাবে পালন না করায় আজ আমরা বৌদ্ধরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবহেলিত । বিশেষ করে বৌদ্ধরা, বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে অহিংসা পরায়ন হয় না । যারা সমাজের কান্ডারি বলে সমাজে কান্ডারির আসন দখল করে আছে তাদের অনেকের কারণে সমাজ উন্নতির চেয়ে বেশি ক্ষতি গ্রস্ত। আমরা যারা সমাজের উন্নতির কথা ভাবি আবার দেখা যায় তারা নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে সমাজের ক্ষতি সাধন করে থাকি। আজ সে সকল সমাজ সেবকদের কারণে বৌদ্ধ পাড়ায়, বৌদ্ধ বিহারের পাশে, অন্য ধর্মের অনুসারিরা বসত-বাড়ী নির্মাণ করে বিভিন্ন ভাবে আমাদের ধর্মের ক্ষতি সাধন ও ক্ষতি কারক হিসাবে রুপ নিচ্ছে। তারা কি একটু ও চিন্তা করেন না। আমার সামান্য স্বার্থের জন্য আমার ধমের্র-সমাজের-পরিবারের অপূরনীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। যদি চিন্তায় আসতো তবে ভাই-ভাই এর সাথে বিবাদ করে, অহিংসা নীতি ভুলে গিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারিদের হাতে পূর্ব পূরুষের বাড়ী, পুকুর, শশ্মন তুলে দিতো না। এই সকল সমস্যায় চোখ-কান না দিয়ে মৃত বাসরে স্মৃতিচারণ করে –অপরের সমালোচনা করে-সংগঠন করে-বিহার ভিত্তিক রাজনীতি করে কি সমাজের উন্নতি সাধন করা যাবে। আমাদের মাঝে বুদ্ধের অহিংসা নীতি যথাযথ ভাবে  আচরণের অভাবে উন্নতির স্তানে অবনতির আলামত দেখা যাচ্ছে।

শাক্যমিত্র বড়ুয়ার একটি কীর্তনে গেয়েছেন-আমরা নাকি বৌদ্ধ জাতি সবাই বলে সরলমতি..... গানের কথাটা শত ভাগ সত্য। কিন্তু আমরা সরল অন্য ধর্মের অনুসারিদের ক্ষেত্রে,বৌদ্ধরা বৌদ্ধেদের জন্য সরল না, ভাই-ভাই এর ক্ষেত্রে অনেক কঠিন, পিতা-পুত্রের ক্ষেত্রে অনেক কঠিন, আতয়-আতয় ক্ষেত্রে স্বার্থের জন্য অনেক কঠিন রুপধারণ করেন। একে অন্যের প্রতি হিংসা পরায়ন হয়ে অশোভনীয় কার্য্য, অসহনীয় আঘাত অপ্রতাশিত দুঃখ দিচ্ছে এবং দুঃখ পাচ্ছে।
 ভিক্ষু সমাজে অহিংসা নীতির প্রতিপালন:
অহিংসকা যে মুনয়ো নিচং কায়েন সংবুতা
তে যন্তি অচ্চুতং ঠানং যত্থ গন্ত¡া ন সোচরে।     ২২৫ ধর্মপদ
যে সকল মুনি অহিংসা পরায়ণ এবং সতত কায়-সংযত, তাহাঁরা
এমন অচ্যত স্থানে (নিবার্ণে) গমন করেন,যেখানে গিয়া শোক করিতে হয় না।
যার মধ্যে অতীতের অনন্ত পূর্ণরাশি ও ভিক্ষু জীবন লাভের পারমী  ব্রিধমান একমাত্র সেই পারবে এই দুলর্ভ ও অতুলনীয় ত্যাগী জীবন যাপন করতে, যার-তার পক্ষে ত্যাগী জীবন লাভ করা সম্ভব নয়। (কথার কথা অনেক কিছুই  বলা যায় কাজে পরিণত করা অনেক কষ্টের) একজন ত্যাগী জীবন যাপন কারী শীলবান ভিক্ষুর পক্ষে কি সম্ভব,অন্য নিকায়ের ভিক্ষুর প্রতি হিংসা পরায়ন হয়ে নিজ নিকায়কে বড় করতে এবং নিজেকে শীলবান সাজাতে আমার মনে হয় সম্ভব নয়। আমি যদি প্রকৃত শীলবান হই আমার নিকায় যদি বিশুদ্ধ হয় তবে আমার শীলময় জীবনের সুগন্ধ বাতাসের অনুকূলে ও প্রতিকূলে প্রভাহিত হবে (বুদ্ধ বলেছেন )। যে প্রকৃত জ্ঞানী যে কখনো বলবে না আমি জ্ঞানী অন্য সবাই মূর্খ।

মাঝে মাঝে বিভিন্ন দূর গ্রামের উপাসক/ উপাসিকাদের সাথে দেখা হয়, প্রথমে বন্দনা করেন তার পর নাম জিজ্ঞাসা করেন,কোন বিহারে অবস্থান করি তা জানতে চান। আমি আস্তে আস্তে সব সঠিক ভাবে বলি সব জানার পর উপাসক বা উপাসিকাটি বলেন আপনিতো ঐ নিকায়ের ভিক্ষু তার পর শুরু হয় শিশুকাল থেকে শিক্ষা দেয়া সেই সমাজের ক্ষতিকর বাণী আমাদের নিকায়ের ভিক্ষুর কাছ থেকে শুনেছি আপনাদের নিকায়ের ভিক্ষুরা বিনয় মানে না। এমন করেন-তেমন করেন। তখন আমি কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি শুধু চিন্তা শক্তি দিয়ে চিন্তা করি আমরা ভিক্ষুরা বুদ্ধের অহিংসা নীতি কিভাবে আচরণ করছি। এটাই কি তার নমুনা, যেমন বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রধান বিরোধী দল বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে সুকর্মকে ধামাচাপা দিচ্ছে, ঠিক সেরুপ ভাবে বর্তমানে কিছু নাম ধারী শীলবান ভিক্ষু পূর্ব পূরুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে এবং পূর্ব পূরুষের অবদানকে অস্বীকার করছে।
আমরা ভিক্ষুরা রাস্তায় চলাফেরা করার সময় কিছু ব্যধর্মী লোক আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে অপমানিত করার জন্য বিভিন্ন কথা বলেন - যেমন মোরগ আছে মুরগি নাই(রাতা আছে খুওরি নাই)
লাউলি-পাওলি ইত্যাদি শুনে মনে বড় কষ্ট লাগে। আবার যখন বুঝতে পারি তারাতো আমাদের ব্যাপারে বা আমাদের ধর্মীয় ব্যাপারে জানেন না তাই বলছে তখন কষ্ট অনেকটা কমে যায়। যখন শুনি আমাদের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি উপাসক-উপাসিকাদের মুখ থেকে আপনিতো ঐ নিকায়ের ভিক্ষু , ঐ নিকায়ের ভিক্ষুরাতো বিনয় মানে না, একথা শুনার সাথে সাথে মনে হয়,দেবদত্ত যে পাথরটি বুদ্ধের উদ্দেশ্য মেরেছিল সেটি যেন আমার মাথায় পড়ল।
হিন্দু বা সনাতন ধর্মে দেখা যায় ব্রাক্ষণ বংশের লোকজন যদি যোগী বংশের অথবা কর্মকার বংশের লোকজন এর সাথে বসে আহার করেন তবে ব্রাক্ষণ এর পাপ হয় অথবা জাত যাবে। ভগবান বুদ্ধ মানুষ মানুষের সাথে পাশে বসে আহার করলে ধর্ম বা জাত চলে যাবে অথবা পাপ হবে(আমার জানা মতে ) এ রকম কোন বাণী প্রচার করেননি। বুদ্ধ বলেছেন পাপীকে নয় পাপকে ঘৃণা কর। ঐ নিকায়ের ভিক্ষু এ নিকায়ের ভিক্ষুর সাথে বসে আহার করলে কি ভিক্ষুত্ব চলে যাবে না কি শীলের পরিহানি হবে। যদি শীলের পরিহানি হয় তবে যারা এরুপ বলেন আবার তারাই বৌদ্ধ প্রতিরুপ দেশ (থাইল্যান্ড) গিয়ে বুদ্ধেও বিনয় বহির্ভূত ভিক্ষুদের সাথে আহার করেনÑসংঘদান গ্রহণ করেন। যাদেরকে থাইল্যান্ড ভিক্ষু মহাসভার বিজ্ঞ ভিক্ষু- সংঘ বুদ্ধের বিনয় সংশোধণ করে ভিক্ষু বা উপসম্পদা দেবার ব্যাবস্থা করেছেন। বাংলদেশের বিনয়ধারী ভিক্ষুরা থাইল্যান্ডের নপুংসক ভিক্ষুদের সাথে সংঘদানে অংশগ্রহণ করলে কিছু যাই আসে না। আমরা ভিক্ষুরা ধর্মদেশনা করার সময় বলে থাকি একজন দুঃশীল ভিক্ষু সংঘের সাথে একত্রিত হলে সেই দুঃশীল ভিক্ষু দুঃশীল দূরীভূত হয় সংঘের গুনের প্রভাবে, সংঘ সব সময়, সব স্থানে সর্ব অবস্থান বিশুদ্ধ ঐ দেশনার বাণী যদি সত্য হয় তবে ঐ নিকায়ের ভিক্ষুর সাথে আমি যদি সংঘদানে অংশগ্রহণ করি বা আহার কার্য্য সম্পন্ন করি তবে আমার শীলের পরিহানি হবে বলে আমার মনে হয় না। বৌদ্ধ জনসাধারণের উন্নতির কথা চিন্তা করে গৃহী সমাজ ও ভিক্ষু সংঘ আমরা সকলে একত্রিত হয়ে বুদ্ধের অহিংসা বাণী অনুশীলন করে বাংলাদেশী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধন করতে পারি,তবে আমাদেরকে ক্ষুদ্র বিষয় ত্যাগ করতে হবে,চিন্তায় আনতে হবে কিভাবে শান্তপ্রিয় বৌদ্ধ জনসাধরণের বৃহৎ কল্যাণ সাধন করা যায়। আমরা বৌদ্ধরা রাজনীতি করি শুধু বিহার নিয়ে তার চেয়ে বেশি দূর যাওয়া হয়ে উঠে না। বিহার ভিত্তিক রাজনীতি পরিত্যাগ করে সামাজিক ভাবে,সাংগঠনিক ভাবে ও রাষ্ট্রিয় ভাবে উন্নতি সাধন করে সম্মানিত আসনে আসিন হওয়া আমাদের লক্ষ হউক। আসুন আমরা সবাই এক সাথে বুদ্ধের অন্যতম বাণী অহিংসা পরম ধর্ম যথাযথ ভাবে আচরণ করি এবং আমাদের আচারণের দ্ধারা নতুন প্্রজন্ম যুবসমাজ হিংসা পরিত্যাগ করে একত্রিত হয়ে বৃহৎ উন্নতি সাধন করুক।
পরিশেষে আশা করি,বিজ্ঞ ভিক্ষু মহোদয়গণ ও সুধীমহল আমার ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং এ বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে সমাজের কল্যাণ সাধনে এগিয়ে আসবেন। 
               বাংলাদেশী সকল বৌদ্ধদের মনে প্রাণে
               বুদ্ধের অহিংসা নীতি প্রচলিত হউক।

লেখক-ভদন্ত প্রিয়দেব ভিক্ষু,অধ্যক্ষ-অজান্তা নগর, অজান্তা বিহার,বৌদ্ধ পল্লী,চট্টগ্রাম।

4 comments: