নববর্ষের অভিভাষণ
নববর্ষের অভিভাষণ
২৬ তম সংঘনায়ক, দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাথেরো
২৬ তম সংঘনায়ক, দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাথেরো
আজ ১৩৮১ সালের প্রারম্ভের দিন, ১লা বৈশাখ। এই নববর্ষের শুভ সূচনায় আমার শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানাচ্ছি আপনাদের সকলকে। কালের চলমান গতিতে নববর্ষের সূচনা নিয়ে প্রতিবছর আমাদের নিকট উপস্থিত হয়।
বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে জীবন দর্শন। জীবনকে সম্যকরূপে দর্শন করতে গেলেই “দুঃখ সত্যের” উপলদ্ধি করতে হয়। এই উপলদ্ধি যথার্থতার সন্ধান দেয় এর পিছনের কারণ। দর্শনের পরিভাষায় একে বলা হয় সমুদয় সত্য। দুঃখ এবং দুঃখের কারণ রোধ করতে গেলেই সন্ধান করতে হয় পথের। এই হচ্ছে- আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই পথ ধরে অগ্রসর হলেই দুঃখের নিরোধ হয়। এই কারণে প্রয়োজন বোধে ধর্ম বা স্বভাব বদলাতে হয়। বৌদ্ধধর্ম এবং তার সংঘের আবির্ভাবের পর থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জগতের সঙ্গে তাল রেখে চলতে শিক্ষা করেছেন। মনকে শুদ্ধ রেখে আপনার চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তথাগতের নির্দেশ ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’ বাণীর সার্থক রূপায়ন করেছেন। এর ফলে আমরা দেখি অতীত ভারতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি এবং বহির্বিশ্বে বিশেষতঃ এশিয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গঠনমূলক অবদান।
আমাদের ভাবতেও বিস্ময় লাগে বৌদ্ধধর্মের মর্যাদা আমরা ভারতবর্ষে রাখতে দৃষ্টিকোণ থেকে তা খানিকটা সত্য বটে, কিন্তু আমার মতে আমাদের শীল বিপত্তি এর জন্য মূলতঃ দায়ী। আমাদের পরস্পরের বিদ্বেষের কারণে এসব হয়েছে। ইদানিংকালে নবদীক্ষিত কতিপয় মহারাষ্ট্রীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত লাভের সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি তাদের ভিতর যে শক্তি আছে তা সারা ভারতবর্ষকে আলোকিত করতে পারে। কিন্তু তাদের উপযুক্ত শিক্ষক নেই। এর অভাবে তাদের সুমহান প্রয়াস হয় ব্যর্থ হতে পারে। ওদের জন্য কি আমাদের কিছু করণীয় নেই? ভারতীয়দের মধ্যে কোন উন্নতমানের সন্তান যদি জন্মগ্রহণ না করে বাইরের কারও পক্ষে সম্ভব নয় যে ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনঃজাগরণ করে।
বুদ্ধ বলেছেন মনুষ্যত্ব লাভ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তিনি দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন মনুষ্যত্বের পরম প্রকাশ তার সুমহান ত্যাগের ভিতর। এই কারণে তিনি বলতে পেরেছিলেন- সমগ্র প্রাণীর কল্যাণের উপর ব্যক্তির কল্যাণ নির্ভরশীল। জ্ঞান ব্যক্তির এককভাবে সম্পূর্ণ নয়। তার ইন্দ্রিয় গ্রাস যথার্থ প্রমাণ। তা ভিতরে চক্ষুকর্ণ নাসিকা এবং মন, বাহিরে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ এবং ভাবের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা অনাত্মাবাদ সিদ্ধ করেছে, যারই পটভূমিকায় বিশ্বের প্রথম সংঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম তিনটি রতেœ বিশ্বাস করে। প্রথম রতœ হচ্ছে জ্ঞান বা বুদ্ধ; দ্বিতীয় রতœ হচ্ছে ধর্ম, তৃতীয় হচ্ছে সংঘ।
বুদ্ধ জানতেন জ্ঞানের সঙ্গে কর্মের অর্থাৎ চরিত্রের যদি সমন্বয় না ঘটে তা হলে যথার্থ কর্মসিদ্ধি সম্ভব নয়।
আমি আশা করি কর্মে, চিন্তায়, বাক্যে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আমরা প্রতিষ্ঠাকে দেখব।
বিঃ দ্রঃ- এই রচনাটি জগজ্জ্যোতি (কলকাতা) ২০০০ সাল সংখ্যা থেকে সংকলিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিতÑ
0 comments: