কোশল রাজের ষোল মহাস্বপ্ন

কোশল রাজের ষোল মহাস্বপ্ন



একদিন কোশলরাজ প্রসেনজিত রাত্রে পর পর ষোলটি ভয়ানক স্বপ্ন দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঘুম থেকে জাগ্রত হন। সকালে পুরোহিত ব্রাহ্মণ এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনে বললেন- স্বপ্নসমূহ বড়ই অকুশলজনক। এতে রাজ্য অন্তরায়, জীবন অন্তরায় কিংবা ভোগ-অন্তরায় এ তিনটির যে কোন একটি ঘটতে পারে। এর প্রতিকারের ক্ষমতা আমাদের আছে। আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই মহারাজ। কি প্রতিকার রাজা জিজ্ঞেস করলে ব্রাহ্মণ বললেন মহারাজ শান্তি স্বস্ত্যয়নের জন্যে সর্বচতুষ্ক যজ্ঞ করতে হবে। ভীত ত্রাসিত রাজা যজ্ঞের যাবতীয় দায়িত্ব পুরোহিত ব্রাহ্মণদের হাতে অপর্ণ করে নিশ্চিন্ত হলেন। বিস্তর খাদ্য ভোজ্য ও ধন সম্পত্তি লাভের আশায় ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞানুষ্ঠানের কাজে লেগে যান। যজ্ঞ স্থান নির্বাচন, বলির জন্যে সবলকায় পশুপক্ষী সংগ্রহ, যজ্ঞের বিবিধ উপকরনাদি সংগ্রহের জন্যে চারদিকে লোকজন প্রেরণ করা হল। রাজ কর্মচারীদের মধ্যে হাঁকডাক বেড়ে গেল। এদিকে কোশল রাজের প্রধানা মহিষী মল্লিকা দেবী সব জ্ঞাত হয়ে রাজাকে জেতবনে ভগবান বুদ্ধের নিকট গিয়ে স্বপ্ন বিবরণ জানাতে অনুরোধ করলেন। রাজা জেতবন বিহারে গিয়ে ভগবান বুদ্ধকে বন্দনা করে স্বপ্ন বৃত্তান্ত একের পর এক শুনাতে আরম্ভ করেন এবং ব্রাহ্মণদের সিদ্ধান্তের কথাও জানালেন।
প্রথম স্বপ্ন : কৃষ্ণ বর্ণের চারটি বৃষ চারদিক থেকে এসে রাজ ময়দানে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। বৃষ যুদ্ধ দেখার জন্যে বন্থলোক সমাগত। কিন্তু বিনাযুদ্ধে তারা ক্ষান্ত হয়ে গেল। এর কারণ কি?
প্রথম স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : মহারাজ এ স্বপ্ন ফল আপনার আমার জীবিতকালে ঘটবে না, ভবিষ্যতে ঘটবে। এতে আপনার কোন অন্তরায়ও হবে না। ব্রাহ্মণগণ কেবল নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে বলেছে। ভবিষ্যতে রাজা প্রজারা হবে কৃপণ ও অধার্মিক তাদের কুশল ধর্মহীন প্রায়  হবে, অকুশল বেড়ে যাবে। নিয়মিত বারিবর্ষণ হবে না অনিয়মিত বৃষ্টিতে শস্য নষ্ট হবে। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। চারদিকে মেঘ উঠবে, মেঘ গর্জনে বিদ্যুৎ চমকাবে, কিন্তু বৃষ্টি হবে না বিনাযুদ্ধে বৃষদের প্রস্থানের ন্যায় মেঘসমূহ চলে যাবে।
দ্বিতীয় স্বপ্ন : ছোট ছোট গাছগুলো এক বিঘত কিংবা দেড় বিঘত বৃদ্ধি পেতে না পেতে ফুল ও ফল প্রসব করল, এ কারণ কি?
দ্বিতীয় স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : মহারাজ! ভবিষ্যতে সমাজের দুরবস্থায় মানুষ হবে অল্পায়ু, হবে তীব্র রাগ পরায়ন, অল্প বয়সে মেয়েরা হবে ঋতুমতী ও ফলের ন্যায় পুত্রকন্যা প্রসব আবার তাদের থেকে অল্পবয়ষ্ক ও রোগাক্রান্ত পুত্রকন্যা জন্ম নেবে। এতে আপনার কোন অনিষ্ট ঘটবে না।
তৃতীয় স্বপ্ন : গাভীরা সদ্য প্রসূত বাছুরের দুধপান করছে এর কারণ কি?
তৃতীয় স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : ভবিষ্যতে যখন বায়োজোষ্ঠদের সম্মান নষ্ট হবে। তখন এসব ঘটবে। পুত্র-কন্যা কিংবা পুত্র বধূরা মাতা-পিতার প্রতি ও শুশুর-শাশুড়ির প্রতি শ্রদ্ধাহীন হবে। নির্লজ্জ্বভাবে স্বয়ং সংসারের ভার গ্রহণ করবে। ইচ্ছা হলে গুরুজনদেরকে খাদ্য বস্ত্র দেবে, ইচ্ছা না হলে দেবে না। কাজেই বৃদ্ধরা নিরুপায় হয়ে বাচ্চার দুগ্ধপায়ী গাভীর ন্যায় সন্তানগণের কৃপাধীন হয়ে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হবে। এতে আপনার কোন ভয়ের কারণ নেই।
চতুর্থ স্বপ্ন : বলবান দৃঢ়কার গরু থাকা সত্ত্বেও অল্পবয়ষ্ক গরু গাড়ী টানতে সংযোজন করল, তারা শকট টানতে অক্ষম বিধায় অগ্রসর হতে পারলনা এর অর্থ কি?
চতুর্থ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : ভবিষ্যতে রাজারা যখন অধার্মিক হবে তখন এ অবস্থা ঘটবে। রাজকার্যে পন্ডিত কুশলী ও কর্মঠ ব্যক্তির পরিবর্তে মুর্খ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিয়োগপ্রাপ্ত হবে। তারা যথাযথভাবে রাজকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হবে না। বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আত্মসম্মান হানির ভয়ে এসব কাজে অগ্রসর হবে না, এভাবে রাজকার্যের পরিহানি হতে থাকবে এবং রাজ্য শ্রী নষ্ট হতে থাকবে। শকট বহনে অসমর্থ তরুণ গরুর ন্যায় হল নব্যলোকেরা আর বলবান গরুর ন্যায় হবে বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা। এতে আপনার কোন ভয় নেই।
পঞ্চম স্বপ্ন : একটি অশ্বের দুটো মুখ দু’মুখেই ঘাস খাচ্ছে এর অর্থ কি?
পঞ্চম স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এ ঘটনাও ভবিষ্যতে অধার্মিক রাজার সময়ে ঘটবে। অনাগতে অধার্মিক মুর্খ রাজাগণ অধার্মিক লোভী ব্যক্তিকে বিচারপতি নিযুক্ত করবেন। তারা বিচারাসনে বসে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষের নিকট থেকে উৎকোচ গ্রহণ করবে। স্বপ্নের অশ্বের ন্যায় দুমুখোই খাবে, এতে আপনার অমঙ্গল হবে না।
ষষ্ঠ স্বপ্ন : বহু মূল্যবান সুবর্ণ পাত্রে একটি জড় শৃগাল প্রস্রাব করল এর অর্থ কি?
ষষ্ঠ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এর ফলও ভবিষ্যতে ঘটবে। অনাগতে অধার্মিক রাজাগণ প্রাচীন সম্মানিত বংশের লোকদেরকে নানা কারণে সম্মান প্রদর্শন করবে না। অকুলীনেরই সংখ্যায় বাড়বে কুলীনগণ দিন দিন গরীব হবে অকুলীন ও নিু শ্রেণীর লোকেরা সম্পদশালী হবে। কুলীন লোকেরা জীবন ধারণের স্বার্থে নীচ লোকদের শরণাপন্ন হবে এবং তাদের সাথে নিজ নিজ কন্যার বিবাহ দেবে। নীচ সহবাসে কুলীন কন্যাগণ মর্যাদা হারাবে, যেমন বহু মূল্যবান পাত্রে জড় শৃগালের প্রস্রাব সৃদশ্য। এতে আপনার কোন অনিষ্ট হবে না।নীচে অবস্থানরত একটি শৃগালী লোকটার অজ্ঞাতসারে ওটা খেয়ে ফেলছে। এর অর্থ কি?
সপ্তম স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এটাও ভবিষ্যতে ঘটবে। অনাগতে নারীগণ পুরুষের সঙ্গ অভিলাষ করবে তারা হবে সুরাপায়ী, অলংকারী লোভী, বিলাসী ও আমিষাশী। সেই দুঃশীল দুরাচারী স্ত্রী স্বামীর সঞ্চিত সম্পদ অকাতরে নষ্ট করবে এবং গোপণে উপপতির সাথে মিলিত হবে। যেমন স্বামীর অজ্ঞাতসারে শৃগালীর রজ্জু ভক্ষণ সদৃশ। এতে আপনার কোন অনিষ্ট হবে না।
অষ্টম স্বপ্ন : রাজদ্বারে একটি বৃহৎ পূর্ণ কলসী এর চারপাশে বহু শূন্য কলসী রয়েছে। লোকেরা ভারে ভারে জল এনে পূর্ণ কলসীতে ঢালছে। কলসীর জল চারদিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও শূন্য কলসীতে কেহ জল ঢালছে না-এর কারণ কি?
অষ্টম স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : ভবিষ্যতে দেশের বড় দুরবস্থা হবে, দেশ বলশূন্য ও ধনশূন্য হবে। রাজাগণ অর্থলোভী হবে। বিভিন্ন ট্যাক্স আদায়ের মাধ্যমে রাজভাণ্ডার পূর্ণ করবে, কিন্তু গরীবের শূন্য ভাণ্ডারের প্রতি তাকাতেও অবসর মিলবে না, যেমনি শূন্য কলসী শূন্যই থাকবে। এতে আপনার কোন অমঙ্গল হবে না।
নবম স্বপ্ন : পঞ্চবর্ণ পদ্ম প্রস্ফুটিত ও চতুর্দিকে ঘাটযুক্ত এক জলাশয়। এর মাঝখানের জল ঘোলা ও পঙ্কিল কিন্তু তৎপার্শ্বের যে জল দ্বিপদ ও চতুষ্পদেরা পান করছে তা পরিষ্কার এর কারণ কি?
নবম স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এসবও ভবিষ্যতের লক্ষণ। যখন রাজাগণ অধার্মিক স্বেচ্ছাচারী ও অবিচারী হয়ে রাজত্ব করবে, ধর্মমতে বিচারাদি করবে না ঘুষখোর হবে ধনলোভী হয়ে প্রজাদের প্রতি মৈত্রীহীন ও দরাহীন হবে। তখন প্রজারা তাদের অত্যাচারে ও উৎপীড়নে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চরে গিয়ে বাসস্থান নির্মাণ করবে। মধ্যাঞ্চল জনশূন্য হতে থাকবে। যেমন পুষ্করিনীর মধ্যস্থিত জল ঘোলা, কিন্তু এই পার্শ্বের জল নির্মল ইত্যাদি। এতে আপনার কোন ভয় নেই।
দশম স্বপ্ন : একটি পাত্রে ভাত রান্না হচ্ছে। এর কোন পাশে পেচাল, কোন পাশে চাউল আর কোন পাশে সুপক্ক। এর কারণ কি?
দশম স্বপ্নের উত্তর ভগবান : এটাও ভবিষ্যতে ঘটবে। যখন রাজাগণ অধার্মিক হবে। তাদের কারণে অন্যান্যরাও অধার্মিক হবে। তখন তাদের রক্ষক দেবতা ভূমিস্থিত কিংবা আকাশস্থিত হোক অধার্মিক হবে। সেই অধার্মিক রাজারা রাজ্য নানাবিধ বিপদ আপদের সম্মুখীন হবে যেমন ঝড়-তুফান, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আত্মকোন্দল বা গৃহযুদ্ধ, বহিঃরাষ্ট্রের আক্রমণ ইত্যাদি। এরূপে একদিকে ভয়ানক বৃষ্টি যার ফলে শস্য নষ্ট, অন্যদিকে বৃষ্টির অভাবে চাষহীন অবস্থা আবার কোনদিকে একাদশ স্বপ্ন : লক্ষ টাকা মূল্যের চন্দন সার অম্লময় দধির বিনিময়ে বিক্রী হচ্ছে এর কারণ কি?
একাদশ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এটা ভবিষ্যতে আমার শাসন ধর্মের পরিহানির সময়ে ঘটবে। ভবিষ্যতে অধিকাংশ ভিক্ষু স্বার্থপরায়ণ ও লজ্জাহীন হবে। লোভের বিরুদ্ধে আমি যা উপদেশ দিয়েছি, ভবিষ্যতে তারা লোভপরবশ হয়ে অর্থের আশায় এ ধর্মোপদেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে। দ্রব্য লোলুপ ভিক্ষুরা নৈর্বাণিক ধর্ম প্রকাশ করতে সক্ষম হবে না। চীবরাদি টাকা পয়সার বিনিময়ে মহামূল্য নৈর্বাণিক ধর্ম তারা সুস্বরে বা মধুর শব্দে প্রচার করবে। যেমন বহু মূল্য চন্দন খারাপ দধির দ্বারা বিক্রিত হচ্ছে। এতে আপনার কোন ক্ষতি হবে না।
দ্বাদশ স্বপ্ন : তুচ্ছ লাউ সকল জলে ভাসছে এর কারণ কি?
দ্বাদশ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এটাও ভবিষ্যতে অধার্মিক রাজার সময়ে লোকের চরিত্র বিকৃত হলে ঘটবে। সে সময় রাজাগণ সম্ভ্রান্ত কুলপুত্রগণকে যশ বা খ্যাতি প্রদান করবে না। অকুলীনদেরকেই প্রদান করবে। অকুলীনেরা সম্পদশালী হয়ে কুলীনেরা দরিদ্র হবে এবং রাজার সম্মুখে, রাজদ্বারে ও বিচার স্থানে অকুলীনদের কথা তুচ্ছ লাউ সৃদশ্য ভেসে থাকবে অর্থাৎ তাদের কথাই গ্রাহ্য হবে। সেরূপ সংঘ মধ্যেও দুশ্চরিত্র, অশিক্ষিত ভিক্ষুরা সাধক ও বিজ্ঞ স্থবিরদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে অর্থৎ সংঘকর্ম ও বিচার স্থানে দুঃশীল ভিক্ষুর কথা অগ্রাধিকার পাবে, সুশীল ভিক্ষুর কথা গ্রাহ্য হবে না। এভাবে সকল স্থানে তুচ্ছ লাউয়ের ভাসায় ন্যায় অধার্মিকদের কথা বলবৎ হবে। এতে আপনার কোন অন্যায় হবে না।
ত্রয়োদেশ স্বপ্ন : বৃহৎ কুটাগার সদৃশ্য পর্বত নৌকার ন্যায় ভাসমান দেখলাম এর কারণ কি?
ত্রয়োদশ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এটাও ভবিষ্যতে ঘটবে সে সময় অধার্মিক রাজাগণ অকুলীনদেরকে সম্মান প্রদর্শন করবে, তারাই ধনশালী হবে। কুলীনেরা দরিদ্র হেতু অকুলীনদের সম্মান করবে। রাজার সম্মুখে অমাত্য সম্মুখে ও বিচার স্থানে তারা ঘনশিলা সৃদশ্য গ্রহণীয় বা যোগ্য হবে। কুলীনেরা উপহাসের পাত্র হবে। ভিক্ষু সভায় শীলবান ভিক্ষুরা তদ্রুপ হবে। ঠিক যেমন ভাসমান শিলা সদৃশ হবে। এতে আপনার কোন ভয় নেই।
চতুর্দশ স্বপ্ন : ক্ষুদ্র মধুক পুষ্পপ্রমাণ ভেক সমূহ ভীষণ কৃষ্ণ সর্পকে দৌড়ায়ে পদ্ম মৃণালের ন্যায় ছিড়ে ছিড়ে মাংস খেতে ও গিলতে দেখলাম এর কারণ কি?
চতুর্দশ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এ স্বপ্নফলও ভবিষ্যতে সমাজের দুরবস্থা হলে ঘটবে। সে সময় মানুষেরা হবে তীব্র রাগ পরায়ণ বা কামাতুর, কাজেই অর্থাৎ ভার্যার উপর আপনার মুখ স্বাধীনতা বলিদান করবে। কোনদিন গৃহস্বামী কোন জিনিসের তত্ত্ব তালাস করলে স্ত্রী নানাবিধ কটুক্তি করবে এবং যে কোন কার্যে কথা বলতে দেবে না যেমন দাস দাসীর প্রতি লোকে ব্যবহার করে তদ্রুপ নব বধূয়া স্বামী বা গুরুজনের প্রতি সেরূপ ব্যবহার করবে, অর্থাৎ তারাই ঘরের সর্বসর্বা হবে। ঠিক ভেক যেমন সর্প গিলছে। এতে আপনার কোন ক্ষতি হবে না।
পঞ্চদশ স্বপ্ন : সুবর্ণ রাজহংসগণ নানা দোষ সমন্বিত বা কলুষিত কাকের অনুবর্তী হচ্ছে এর কারণ কি?
পঞ্চদশ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এটাও ভবিষ্যতে দুর্বল রাজার সময়ে ঘটবে। ভবিষ্যতে রাজাগণ রাজ্য শাসন কিংবা যুদ্ধে বিদ্যায় সুনিপণ হবে না। তাহারা পদচ্যুত হবার ভয়ে সম্ভ্রান্তগণকে কার্যভার না দিয়ে স্বীয় পদসেবাকারী ক্রীতদাস বা নীচ বংশীয় দাসগণকে প্রধান্য অর্পণ করবে। জাতি গোত্র সম্পন্ন কুলপুত্রেরা রাজকূলে প্রতিষ্ঠা লাভ না করে এবং জীবন যাপন করতে অসমর্থ হয়ে এসব ক্রীতদাস বা জাতি গোত্রহীন অকুলীনের সেবা শুশ্রƒষা করে বিচরণ করবে। ঠিক যেমন সুবর্ণ রাজহংস কাকের অনুবর্তী হচ্ছে। এতে আপনার কোন ক্ষতি হবে না।
ষোড়শ দশ স্বপ্ন : নেকড়ে বাঘ মেষ খায়, তা জানি। কিন্তু মেষ সমূহ হিংস্র বাঘকে দৌড়ায়ে খাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে অন্যান্য প্রাণীরা ভয়ে ঝোপ ঝাড়ে আশ্রয় নিচ্ছে এর কারণ কি?
ষোড়শ স্বপ্নের উত্তরে ভগবান : এটাও ভবিষ্যতে অধার্মিক রাজার সময়ে ঘটবে। যে সময়ে নীচ বংশীয়রা রাজ প্রাসাদে প্রাধান্য লাভ করবে। কুলীনগণ অপমানিত ও নিরন্ন হবে। যেমন সম্ভ্রান্তেরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাদের হাতে লাঞ্চিত ও অপমানিত হওয়ার ভয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে। তদ্রুপ অদূর ভবিষ্যতে শীলবান ভিক্ষুরা পাপী ভিক্ষুব উৎপীড়নে নিরাশ্রয় হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় করবে বা পালিয়ে থাকবে। এতে আপনার কোন ভয়ের কারণ নেই মহারাজ।
ষোল প্রকার মহাস্বপ্নের ব্যাখ্যায় রাজা প্রসেনজিৎ ভয়হীন ও আনন্দিত হয়ে যজ্ঞ ত্যাগ করলেন এবং প্রাণী সমূহের বন্ধন মোচন করে দিলেন।

0 comments:

বুদ্ধের নিকট শুভ মানবের চতুদর্শ প্রশ্ন

বুদ্ধের নিকট শুভ মানবের চতুদর্শ প্রশ্ন

১। মানুষের অল্পায়ু হয় কেন?
২। মানুষের দীর্ঘায়ু হয় কেন?
৩। মানুষ ব্যাধিগ্রস্ত হয় কেন?
৪। মানুষ নিরোগী হয় কেন?
৯। মানুষ অল্প ভোগ সম্পদশালী হয় কেন?
১০। মানুষ হীন বংশজাত হয় কেন?
১১। মানুষ মহা ভোগশালী হয় কেন?
১২। মানুষের মধ্যে কেহ উচ্চ বংশীয় হয় কেন?
১৩। মানুষের মধ্যে দু®প্রাজ্ঞ হয় কেন?
১৪। মানুষের মধ্যে প্রজ্ঞাবান দেখা যায় কেন?
* মানবগণের মধ্যে এরূপ হীন শ্রেষ্ঠ তারতম্য দেখা যায় কেন?
বুদ্ধের উত্তর : হে শুভ জীবগণ স্বকৃর্ত কর্মই ভোগ করে। স্বীয় স্বীয় কর্মেরই উত্তরাধিকারী হয় কর্মানুযায়ীই জন্ম গ্রহণ করে, কর্মই নিজের বন্ধু স্বরূপ এবং কর্মই নিজের আশ্রয় স্বরূপ। কর্মই সত্তদিগকে হীন শ্রেষ্ঠে বিভাগ করে পন্ডিতাভিমানী শুভ ভগবানের এ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর বুঝতে না পেরে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করার জন্য পুনঃ ভগবানকে প্রার্থনা করলেন। ভগবান পুনঃ তা বিস্তৃতভাবে বলতে আরম্ভ করলেন।

শুভমানবের প্রশ্নের বিস্তৃত উত্তর
১। প্রাণী হত্যাকারী নর-নারীগণ মৃত্যুর পর তির্যক, প্রেত, অসুর ও নিরয়াদিতে উৎপন্ন হয়। তারা মনুষ্য জীবন লাভ করলেও অল্পায়ু সম্পন্ন হয়। 
২। প্রাণীদের প্রতি মৈত্রী পরায়ন ব্যক্তিগণ মৃত্যুর পর স্বর্গ কিংবা মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হয়ে দীর্ঘায়ু সম্পন্ন হয়। 
৩। হস্ত, দন্ত, ঢিল ও অস্ত্রের দ্বারা প্রাণীকে নিপীড়নকারী ব্যক্তিগণ চারি অপায়ে উৎপন্ন হয়। তারা মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হলেও দুরারোগ্য পীড়াগ্রস্ত হয়। 
৪। প্রাণীদের প্রতি মৈত্রী পরায়ন ব্যক্তিগণ নিরোগী হন।
৫। ক্রোধান্ধ নর-নারীগণ জন্মে জন্মে বিশ্রী ও কদাকার হয়।
৬। দয়ালু নর-নারীগণ জন্মে জন্মে সুশ্রী ও লাবণ্যময় হয়।
৭। অপরের লাভ সৎকার সম্মান বন্দনা ও পূজা দর্শনে ঈর্ষাপরায়ন ব্যক্তিগণ জন্মে জন্মে পরাক্রমহীন অবহেলার পাত্র হয়।
৮। পরের লাভ সৎকার দর্শনে আনন্দলাভী ঈর্ষাহীন ব্যক্তিগণ জন্মে জন্মে মহাপরাক্রমশালী গৌরবের পাত্র হয়।
৯। কৃপনগণ জন্মে জন্মে ভোগ সম্পত্তি লাভে বঞ্চিত হয়।
১০। দাতাগণ জন্মে জন্মে মহাধনবান হয়। 
১১। অহংকারী ব্যক্তি হীন কুলে জন্মগ্রহণ করে। 
১২। নিরহংকারী নর-নারীগণ জন্মে জন্মে উচ্চ কুলে জন্মগ্রহণ করে।

১৩। যারা কুশলাকুশল সম্বন্ধে জানবার জন্য জিজ্ঞাসা করে না, করতেও চায় না তারা জন্মে জন্মে নির্বোধ হয়।



0 comments:

ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক ভারতের ছয়জন ধর্ম গুরু বা তীর্থিক আর্চাযের মতবাদ

ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক ভারতের ছয়জন ধর্ম গুরু বা তীর্থিক আর্চাযের মতবাদ


১) পূরণ কাশ্যপ : কোন এক ভ্রদলোকের ঔরসে এক বিজাতিয়া স্ত্রীর গর্ভে তার জন্ম হয়। পূর্বে সে বংশে ৯৯ জন জন্মেছিল তার জন্মে একশত জন পূর্ণ হওয়ার সে পূরণ আখ্যা লাভ করে। তার ব্যক্তিগত নাম কাশ্যপ। যৌবনে সে এ দ্বারবানের কাজে নিযুক্ত হয়। এই কাজে সে বিরক্ত হয়ে বনে পলায়ণ করে। তথায় দুস্যুরা তার বস্ত্র কেড়ে নেয়। বিবস্ত্র হয়ে সে নিকটবর্তী গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামবাসীদেরকে সে বলল আমি সমস্ত বিদ্যায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছি বলে লোকে আমাকে পূরণ বলে এবং ব্রাহ্মণ বংশে জন্মেছি বলে লোকে আমাকে কাশ্যপ বলে। তখন গ্রামবাসীরা তাকে বস্ত্রদান করলে সে বলল “লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্র ব্যবহৃত হয় পাপ হতেই লজ্জার উৎপত্তি আমি সমস্ত পাপ-প্রবৃত্তি নির্মূল করেছি। অতএব আমার বস্ত্রের প্রয়োজন নেই। একথা শুনে লোকে তাকে পূজা করতে লাগল। পরে তাঁর পাঁচশত  শিষ্য হয়। আশি হাজার লোক তার মত অনুর্বতন করে।
মতবাদ : তাঁর মতে আত্মা অক্রিয়াশীল। দেহের প্রভাবে কর্ম করা হয় বলে আত্মা দেহের ভাল-মন্দ কর্মের ফলাফল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাই স্বহস্তে করলে বা আদেশ দিয়ে করালে ছেদন করলে বা করালে দণ্ড দ্বারা পীড়ন করলে বা করালে, সিঁদ কাটলে বা কাটালে, চুরি, প্রাণী হত্যা, ব্যভিচার, মিথ্যা ইত্যাদি সর্ববিধ পাপ কাজে লিপ্ত থাকলে অথবা কারও দ্বারা সম্পাদন করালে কোন পাপ নেই। পাপ করছি জেনে পাপ করলেও পাপ হয় না। দান, ইন্দ্রিয় দমন, শীল, সংযম এবং সত্যবাক্য বলার দ্বারাও কোন পুণ্য হতে পারে না। মোট কথা তার মতে পাপ-পুণ্য কিছুই নেই। অকুশল করলেও পাপ হয় না।
২) মক্খলি গোসাল : এর প্রকৃত নাম মস্করি। গোশালায় এক দাসীর গর্ভে জন্ম হওয়ায় তার নাম মস্করী গোশাল হয়। একদিন সে তার প্রভুর আদেশ মত একটি ঘৃত-কুম্ভ মস্তকে করে যেতে হঠাৎ পদস্থলন হয়ে সমস্ত ঘৃত মাটিতে পড়ে যায়। ভয়ে পলায়ণ করতে প্রভু তার বস্ত্র ধরে ফেলেন। সে বিবস্ত্র হয়ে বনে প্রবেশ করে। এরপর নিকটস্থ গ্রামে গিয়ে লোকজনকে প্রতারিত করে। কালে তারও পাঁচশত শিষ্য হয়। অশীতি সহস্র লোক তার মতের অনুসরণ করে। জৈন ধর্মের ঐতিহ্যগত প্রবর্তক পার্শ্বনাথের প্রথম অনুসারী হিসেবে সে আজীবন ধর্ম প্রচার করলেও কোন ফল নেই। পরের উপদেশ পালনেও কোন লাভ নেই। বল বীর্ষ-পুরুষ-শক্তি, পুরুষ-পরাক্রম বা পুরুষকার বলতে কিছু নেই। সর্বসত্ত্ব, সর্বপ্রাণী, সর্বজীব, অধীন, অবল, অবীর্য, নিয়তি, সঙ্গতি ও স্বভাবে তারা নানা প্রকার গতিপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ যা হবার তা হয় না। যা না হবার তা হয় না। চুরাশী মহাকল্পকাল ক্ষেপনান্তে জ্ঞানী ও অজ্ঞানী সকলের দুঃখের অন্তসাধন করবে। এতে অন্যের সাহায্যের কোন প্রয়োজন নেই।
৩) অজিত কেশকম্বলী : প্রভুর ভৎর্সনা সহ্য করতে না পেরে সে সন্ন্যাস অবলম্বন করে। সে কেশ নির্মিত বস্ত্র দ্বারা গাত্র আচ্ছাদিত করত এবং সর্বদা মস্তক মুন্ডল করত। তাই তার প্রকৃত নাম অজিত এর সাথে কেশকম্বল যোগ করে অজিত কেশকম্বলী বলা হয়।
মতবাদ : তার মত দানের যজ্ঞের, অতিথি সৎকারের, সুকৃত-দুস্কৃত কর্মের কোন ফল বা বিপাক নেই। ইহলোক- পরলোক, মাতা-পিতা ও ঔপপাতিক সত্ত্ব নেই। পৃথিবীতে সম্যক প্রতিপন্ন বা সম্যক মার্গলাভী এমন কোন শ্রমণ, ব্রাহ্মণ নেই, যাঁরা স্বয়ং অভিজ্ঞা বলেই লোক ও পরলোক প্রত্যক্ষ করে বলতে পারেন। পুরুষ চার মহাভূত হতে উৎপন্ন। মরে গেলে মাটির অংশ মাটির সাথে, জল জলের সাথে, তেজ তেজের সাথে এবং বায়ু বায়ুর সাথে মিশে যায়। ইন্দ্রিয় সমূহ আকাশে গমন করে। মৃত পুরুষকে চার পায়ার খাঁটিয়া করে শ্মশানে নিয়ে যায়। সেখানে লোক তাঁর গুণাগুণ বর্ণনা করে। অজ্ঞানী ও জ্ঞানী উভয়ে মৃত্যুর পর উচ্ছিন্ন হয়, বিনাশ প্রাপ্ত হয়, মৃত্যুর পর আর জন্মে না। অজিত কেশকম্বলী এরূপ নাস্তিকবাদী ছিল। তার অনেক শিষ্য প্রশিষ্য ছিল।
৪) পকুধ কচ্চায়ন : এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণ বংশে এক বিধবার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। পকুধ বৃক্ষমূলে তার জন্ম হওয়ায় পকুধ কচ্চায়ন নায়ে প্রসিদ্ধি লাভ করে। জনৈক ব্রাহ্মণ তাকে প্রতিপালন করেন। ব্রাহ্মণের মৃত্যু হলে জীবিকা নির্বাহের উপায় না দেখে সন্ন্যাস অবলম্বন করে।
মতবাদ : তার মতে পৃথিবীকায়, আপকায়, তেজকায়, বায়ুকায়, সুখ-দুঃখ ও জীব এই সাতটি কাঁয় অকৃত, অকারিত, অর্নিমিত, বন্ধ্য, কটুস্থ, ইন্দ্রখিল সদৃশ স্থিত। তারা কম্পিত হয় না, বিপরিণাম প্রাপ্ত হয় না, পরস্পরের বাধা জন্মায় না, পরস্পরের সুখ-দুঃখের হেতুও নহে। কোন হন্তা নেই। হনন করবারও কেহ নেই। শ্রোতা, বক্তা, বিজ্ঞতা কেহ নেই, বিজ্ঞাপন কর্তাও নেই। তীক্ষ্ম অসিদ্বারা শিরচ্ছেদ করলেও কেহ কারও জীবন হত্যা করতে পারে না অপিচ এ সাত কায়ের অন্তরে বিবয়ে শস্তু প্রবেশ করে মাত্র।
৫) নিগন্ঠ নাতপুত্র : নাত নামক কৃষকের পুত্র। নিগন্ঠ বা নির্গ্রন্থ বলা হয় এ যে তিনি বলতেন এমন কোন গ্রন্থ নেই আমি পাঠ করিনি। এ কারণে তিনি নির্গ্রন্থ নাত পুত্র নামে পরিচিত। তিনি পার্শ্বনাথের জৈন ধর্মের প্রবক্তা।
মতবাদ : তাঁর মতে শীতল জল ও প্রাণী বিশেষ। এ হেতু শীতল জলও ব্যবহার করতে নেই তিনি সর্ব পাপ হতে বিরত সমস্ত পাপ বিধৌত ও সর্ব পাপ দূরীকরণে লগ্ন চিত্ত। এহেতু তিনি অন্ত প্রাপ্ত চিত্ত, সংযম ও সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর পঞ্চশত শিষ্য ছিল।
৬) সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্র : বেলাস্থি নাুী দাসীর গর্ভে তার জন্ম হয় বলে বেলট্ঠি পুত্র। তার মস্তকে সঞ্জয় ফলের ন্যায় মাংসপিন্ড বিদ্যামান থাকায় সে সঞ্জয় বেলাস্থি পুত্র নামে প্রসিদ্ধ হয়। তার অনেক শিষ্য ছিল।
মতবাদ : তার মতবাদ হল আমরা বিক্ষেপবাদ। সে কিছুতেই ধরা দিত না। প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হলে বলতো, ‘এরূপও আমি বলিনা, সেরূপও আমি বলি না, অন্যথায় আমি বলি না , না বলেও আমি বলি না।” এরূপ উত্তর দিয়ে সে বাক্য বিক্ষেপ করতো। এরূপ করার কারণ হল যে মিথ্যা ধরাপড়ার ভয়, সেহেতু সে কিছুই সঠিক জানতো না। এভাবেই সে তার মতবাদকে বাঁচিয়ে রাখতো। তার ভ্রান্ত ধারণা ছিল বিধায় কর্মের ফলাফলকে সে প্রাধান্য দিত না। তার ধারণা যে, ইহ জন্মে যে যেভাবে আছে অর্থাৎ দ্বিপদ, চতুষ্পদ ইত্যাদি বন্থবিধ প্রাণী, তারা পর জন্মেও ঠিক সেই অবয়ব প্রাপ্ত হবে। এক সময়ে মগধরাজ অজাতশত্র“ তাঁর পরম গুরু দেবদত্তের মৃত্যুর পর মানসিক শান্তি আনয়নের উদ্দেশ্যে এই ছয়জন তীর্থঙ্করের নিকট একের পর এক গমন করেন। কারো মতবাদে তিনি মানসিক শান্তি লাভ করতে পারেন নি। বরং তিনি ছয় শাস্তার মধ্যে সঞ্জয়কে সর্বাপেক্ষা অজ্ঞানী বলেছেন। পরিশেষে তিনি রাজ বৈদ্য জীবকের পরামর্শে তথাগত বুদ্ধের নিকট যান এবং বুদ্ধের “শ্রামণ্য ফল সূত্র” দেশনায় অতীব প্রীত হয়ে ভগবানের শরণাগত উপাসক হন। পরিব্রাজক সুভদ্র ও এই ছয় জনের মতবাদে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ভগবানের অন্তিম সময়ে তাঁরই সত্য ধর্ম দেশনা শুনে পরম শান্তি নির্বাণ সাক্ষাৎ করেন।

0 comments:

সমালোচনা

                       
সমালোচনা
সমালোচনা কথাটি আাকারে ছোট কিংবা বলতে কম সময় লাগলে ও এর বিশালত্ব কিন্তু কম নয়। সমালোচনাকে যদি আমরা সন্ধি বিচ্ছেদ করি তাহলে দাড়ায় সম+আলোচনা=সমালোচনা। আর একে আবিধানিক অর্থ দ্বারা বিশ্লেষন করলে হয়, ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রদর্শন পূর্বক আলোচনা। অর্থাৎ কারো দোষ বা ভুল সচক্ষে দেখে আলোচনা করাকে বুঝায়। আবার এটাও ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সাহিত্য বা শিল্পের দোষ-গুনের উপর সভ্য আলোচনা। যাইহোক, কয়েকজন মানুষ যখন একত্রে মিলিত হয়ে কোন একটি বিষয়ে আলোচনা করে তখনকতাড় সেটা সমালোচনার পর্যায় পড়ে না, কারণ সেখানে কোন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আলোচনা করা হচ্ছে না। কিন্তু যখন কোন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন সেটা সমালোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। আবার সেই আলোচনা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি জনসমক্ষে বা বৃহত্তর মধ্যে প্রকাশ করা হয় তাহলে তা আর ও বেশি বিরাট আকার ধারণ করে। এখন কথা হচ্ছে আলোচনা বা সমালোচনা এ দুয়ের মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা যতটুকু সমালোচনা করতে অভ্যস্ত,  ততটুকু আলোচনা করতে অভ্যস্ত নই। আবার এটা ও সত্য যে, আমরা নিজেকে নিয়ে যতটুকু না সমালোচনা করি, অপরকে নিয়ে তার চাইতে বেশি সমালোচনা করি। যদি প্রশ্ন করা হয় এত সমালোচনা কেন, এর কারনই বা কি? এর সহজ উত্তর দাঁড়াবে, সকল প্রানীর মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না এমন কি নিজের স্বার্থের জন্য হীন কাজ করতে দ্বিধা বোধ করে না। যেখানে গর্হিত কাজ করতে বিবেক বাঁধেনা সেখানে সমালোচনা করতে দ্বিধা কোথায়! এক কথায় স্বার্থের তাড়নায় সমালোচনা করা হয়। তাই অপরে কি করছে না করছে সেদিকে লক্ষ্য না রেখে আমি নিজে কি করছি তা লক্ষ্য করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে নিজের দোষ কিংবা ভুল গুলো খতিয়ে না দেখে অপরকে নিয়ে খোঁচাখোচি করছি, আমরা যখন অন্যের সমালোচনা করি, তখন কি একবারও নিজের বিবেককে করার প্রয়োজনবোধ মনে  করি না। কিন্তু যারা প্রকৃত মানুষ এবং জ্ঞানী তারা প্রশ্ন রাখেন বলে মনে হয়, কারণ তারা সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন অপরকে নিয়ে নয় যদিও বা কোন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সমালোচনা করে থাকে তাও সে তার সম জ্ঞানী ব্যক্তির উদ্দেশ্যে করবে এবং ঐ জ্ঞানী ব্যক্তিও তার জ্ঞান দ্বারা পাল্টা জবাব দেবে এটাই হচ্ছে জ্ঞানী লোকের সমালোচনা। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, তারা সমালোচনা করে কোন হীন স¦ার্থের জন্য নয় বরং জ্ঞান আহরনের জন্য।
সুতরাং আমরা যারা সমালোচক ( যিনি বা যারা আলোচনা করেন তিনি সমালোচক) আছি প্রকৃত অর্থে কিন্তু আমরা মানুষ ও নই আবার জ্ঞানী ও নই, শুধু মানুষের অবয়ব ও জ্ঞানীর বেশ ধারণ করে আছি মাত্র। তাইতো যত্রতত্র অন্যের সমালোচনা করি এমন কি স্থান, কাল, পাত্র পর্যন্ত বিবেচনা করিনা। বর্তমানে শুধু নিজেকে জ্ঞানী বলে জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য, অনিত্বকে বড় করার মানসে এবং হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি আর সমালোচনা করি অন্যের। চিন্তা করিনা যে, কেন আমাদেরকে মানুষ বলা হয়, কেন প্রাণীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই কথাটি সঠিক জ্ঞান দিয়ে যদি বিবেচনা না করি তাহলে আমি যে মানুষ হয়তো তাও একদিন ভুলে যাবার সম্ভাবনা আছে।
সুতরাং মানবীয় গুণ, বুঝার ক্ষমতা, আত্মসম্মানবোধ আছেই বলেই আমরা মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাজার সাধনার পরে যে মানবীয় গুন অর্জন করি , তিল তিল করে যে আয়ত্বে এনেছি সে সব ধুলোয় মিশিয়ে দিই আরও বেশি স্বার্থের জন্য।
কথায় বলে একটা পাকা দালান তৈরি করতে এক বছর কিংবা তার ও বেশি সময় লাগে কিন্তু সেটি ভাঙতে খুব কম সময়ের প্রয়োজন হয়। ঠিক তদ্রুপভাবে মানুষের গুনাবলির বেলায় তাই। কি হবে মিছে মরিচিকার পিছনে ছুটে একদিন তো সবাইকে পারাপারের দ্বার গ্রহন করতে হবে তাহলে কেন এতো স্বার্থের জন্য আহাজারি। কেন সত্যকে মিথ্যার চাদরে ঢাকিয়ে এতো সমালোচনা। সত্য সেতো সবসময় সত্য, সেটাকে কখনও মিথ্যার চাদরে লুকিয়ে রাখা যায় না। যেমন করে ইতিহাস বিকৃত করা যায় না। যতই ডাক-ঢোল পিটিয়ে সমালোচনা করা হোক না কেন, সত্য একদিন বেড়িয়ে আসবেই। আর সত্য যখন বেড়িয়ে আসবে তখন কিন্তু ঠিকে থাকা অধিক কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। কারন পৃথিবীর মধেব এমন কোন সত্য বিদ্যমান নেই বা মিথ্যার আশ্রয়ে প্রকাশ পায়নি। ভবিষ্যতেও পাবে। তাই প্রত্যেক সমালোচকের উচিত কারো সমালোচনা করার আগে নিজে কতটুকু সত্য পথে আছেন এবং শুদ্ধতার সহিত জীবন যাপন করেছেন তা বিচার করা। কারণ নিজে যদি গোপনে অনৈতিক কাজ করেন আর নিছক মুর্খতা ছাড়া আর কি হতে পারে। হোক সে প্রাতিষ্ঠানিক দিক দিয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী। সে যদি এ পথের পথিক হতে চায় তাহলে কার কি করার আছে। আমার মনে হয় যারা সমালোচনা করে তারা প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু একটু চিন্তা করিনা যে, এই প্রতি হিংসাই মানব সমাজের অবক্ষয়ের কারন এবং অগ্রযাত্রার অন্তরায়। আবার  আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, কেই সমালোচনা করে তাদের পূর্বপুরুষ কর্তৃক পাওয়া অভ্যাস থেকে। তারা মনে করে আমাদের পূর্ব পুরুষরা করে এসেছে আমরা ও করব কারন উত্তরসুরী হিসেবে আছি বলে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে চলে আসছে, এর শেষ কোথায় আদৌ বলা কঠিন। আর এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে মানব জাতির পথ প্রদর্শক হয়ে পূজা , অর্চনা নেওয়া মানে হয় না। প্রত্যেকে চায় একটি সুন্দর জাতিও সমাজ যেখানে সুস্থভাবে বসবাস করতে পারবে এবন জীবনকে কল্যানের পথে পরিচালিত করতে পারবে। কিন্তু মানুষের জীবনে কল্যানের চেয়ে অকল্যাণই বেশি বয়ে আনে এই সমালোচনা। আমরা অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই আমাদের সমাজ ভঙ্গুর কিংবা পঙ্গু হবার পিছনে দায়ী কিন্তু এই সমালোচনা কিংবা পর নিন্দা। যদিও বা মনে করি যে, নিজের দোষ-ত্রুটিগুলি চেপে রেখে কিংবা অন্যের ঘাড়ে চেপে দিয়ে এবং অপরের সমালোচনা করে জয়ী হয়েছি কিংবা হতে যাচ্ছি তাহলে মনে রাখা প্রয়োজন যে, কোনটি স্থায়ী জয় আর কোনটি অস্থায়ী জয়।
অতএব আমাদের সুযোগ্য সমালোচকবৃন্দগণ ঐগুলি নিয়ে মাথা ঘামান না মাথা ঘামার অবকাশ পাননা জানি না। কিভাবে পাবে তারা তো ব্যস্ত অন্যের সমালোচনা করে, নিজের হীন স্বার্থ হাসিল করা এবং পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রক্ষা করা। তারা বোঝেনা যে, নিজেদের হীন স্বার্থের জন্য মানব জাতির ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে এবং প্রকৃত আলোর সন্ধান না দিয়ে অন্ধকারে যাওয়ার জন্য উৎসাহ যোগান দিচ্ছে। সুতরাং হীন স্বার্থ পরিত্যাগ করে একটি সুন্দর, সুস্থ মানব জাতি তথা সমাজ উপহার দেওয়া সকলের উচিত বলে মনে করি।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক
[ বি:দ্র: আমার এ লেখা কারোর প্রতি আক্রোশবশত নয় বরং বর্তমান সময়ে সমাজে যে সমালোচনার ঝড় বইছে এবং সমাজ যে অবক্ষয় হচ্ছে তাকে নিয়ে]


লেখক সুমনানন্দ ভিক্ষু
অধ্যক্ষ কাঁঠাল ভাঙ্গা সর্বজনীন বৌদ্ধ বিহার।

0 comments:

বৌদ্ধ ধর্মে মার দর্শন

বৌদ্ধ ধর্মে মার দর্শন

     --------ভদন্ত দেবপ্রিয় ভিক্ষু।

বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনে চিরশান্তিময় নির্বান লাভের জন্য সাধনার পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী মারের প্রভাব ও অলৌকিক ক্ষমতার কথা পবিত্র ত্রিপিটক গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ আছে। বিভিন্ন কারণে ও বিভিন্ন স্থানে মার বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। মারের অপর নাম বসবর্তী অন্তকো পমত্তবন্ধু, মারো পাপিমা, শয়তান ইত্যাদি।

যারা কুশলিয় কর্ম করেন, বিমুক্তি সাধনায় রত তাঁরা কুশলে কর্ম সম্পাদনের মধ্য দিয়ে অকুশল ভাবকে তিরোহিত করতে সচেষ্ট।  মার তার প্রভাবের বাইকে যাতে সাধকগণ যেতে না পারে, সে জন্য সাধকের সাধনার পথে বাধা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সময়ে মার তার প্রভাবের দ্বারা সাধককে প্রভাবিত করে। যে সাধক দৃড়চেতা, বীর্যবান মার কোন ক্রমেই তাঁদেরকে প্রভাবিত করতে পারে না। সংসার জীবনে যেরূপ দেখা যায়, অনেক দুষ্ট প্রকৃতির লোক সৎ ব্যক্তিদেরকে বিপথগামী করে, তেমনি মারও সাধক ব্যক্তিদেরকে কৃ-পথে ধাবিত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

* মারের প্রকারভেদ ঃ
পবিত্র ত্রিপিটকে পাঁচ প্রকার মারের কথা উল্লেখ আছে- যথা
ক) স্কন্ধ মার
খ) মৃত্যু মার।
গ) ক্লেশ মার।
ঘ) অভিসংস্কার মার।
ঙ) দেবপুত্র মার।
ক) স্কন্ধ মার ঃ রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে পঞ্চ স্কন্ধ বলা হয়। ইহা নাম-রূ, এই জন্মে শীল ভঙ্গের কারণে কতগুলি কায়িক-বাচনিক ও মানসিক কু-অভ্যাস রপ্ত হয়ে থাকে। যেমন-বাজে কথা বলা, হাত-পা অথবা মাথা দোলাতে দোলাতে কথা বলা, চঞ্চল স্বভাবের কারণে নানা অঙ্গ-ভঙ্গি ব্যক্ত করা, ঢেকুর তোলা, শারীরিক ব্যধি, খিটখিটে মেজাজ, বদরাগী, হিংসুটে ভাব, ইর্ষাপরায়নতা-মাৎসর্যভাব ইত্যাদি প্রকাশ পায়। অনেকে আবার পূর্ণময় কাজের দ্বারা কায়-বাক্য, মনের দ্বারা সৎকাজ, পুষ্প পূজা, প্রদীপ পূজা ইত্যাদি করেন থাকেন। স্মৃতি ভাবনার সময় উপরোক্ত দূষণ স্বভাব ও সৎ-স্বভাবগুলি কায় বাক্য এবং মনে বিকাশ লাভ করে প্রতিবন্ধক হয়ে পড়ে এজন্য এগুলিকে স্কন্ধ মার বলা হয়েছে।

খ) মৃত্যু মার ঃ ‘‘জাতস্য হি ব্রবোমৃত্যু  জাতের মৃত্যু ধ্র“ব সত্য। মৃত্যু বলতে সত্ত্বগণের বর্তমান দেহের নাম ও রূপ স্কন্ধের চ্যুতি। চবনতা, অর্ন্তধান, কালক্রিয়া বা কালনিক্ষেপ বুঝায়। পঞ্চ স্কন্ধ বা পঞ্চভৌতিক দেহের পতন অবশ্যম্ভাবী। সকল জীব মাত্রই মৃত্যুর অধীন বলে জন্ম ধারণ দুঃখজনক। জন্ম হলে মৃত্যু হবে। কেউ মৃত্যু পথকে রোধ করতে পারবে না। মৃত্যু রূপ মার যতকাল পর্যন্ত মানুষ নির্বাণ রাজ্যে প্রবেশ না করে, ততকাল পর্যন্ত মানুষকে গ্রাস করে থাকে। সেজন্য মৃত্যুমার যাতে সাধকগণ তার ক্ষমতার বাহিরে গিয়ে নির্বাণ লাভ করতে না পারে সেজন্য কু-পথে পরিচালনা করতে সচেষ্ট থাকে।

গ) ক্লেশ মার ঃ ক্লেশ শব্দের অর্থ হল চিত্তের কালিমা। চিত্ত সর্বদাই স্বচ্ছ আয়নার ন্যায় নির্মল। স্বচ্ছ আয়নারয় যেরূপ ধূলা বালি দ্বারা আচ্ছ্ন্ হলে প্রকৃত প্রতিবিম্ব অপ্রচ্ছন্ন হয় তেমনি লোভ-দ্বেষ-মোহ রূপ আয়না দ্বারা প্রচ্ছন্ন চিত্ত ক্লেশ মার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়। অভিধর্মে উননব্বই প্রকার চিত্তকে কামাবচর, রূপাবচর, অরূপাবচর ও লোকোত্তর ভেদে চার ভাগে বিভক্ত করপা হয়েছে। এ ঊননব্বই প্রচার চিত্ত বায়ান্ন প্রকার চৈত্তসিক ধর্মের সংস্পর্শে এসে প্রতিক্ষনেই ক্লেশ মার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়। ক্লেশের প্রভাবে পৃথকগণ বিভ্রান্ত হয়ে নানা প্রকার পাপকর্মে লিপ্ত হয়। এহেতু তারা হই জীবনেই মহাদুঃখ ভোগ করে। মৃত্যুর পর নরক তির্যক, প্রেত ও অসুর ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করে অনন্তকাল ধরে অপায় দুঃখ ভোগ করে। আবার কেউ সুগতি ভূমিতে জন্ম গ্রহণ করলেও ক্লেশ মারের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে চির শান্তিময় নির্বাণ লাভ হতে বঞ্চিত হয়।

ঘ) অভিসংস্কার মার ঃ- অভিসংস্কার মার ভোগ চেতনা মার নামে পরিচিত। অভিসংসার তিন ভাগে বিভক্ত। যথা-
১। পুঞঞাভি সংস্কার।
২। অপুঞঞাভি সংস্কার
৩। আনেঞ্জাভি সংস্কার সংস্কাার জন্মের হেতু সৃষ্টিকারী। অভি সংস্কার বলতে ইহ জন্মের সংস্কার ছাড়া ও অতীত অতীত জন্মের অতিরিক্ত সংস্কার এই গুলি বোঝায়?

প্রসঙ্গত ঃ এক সময় একজন শ্রেষ্ঠী ভগবান বুদ্ধের নিকট ক্ষীনাস্রব ভিক্ষুদের আমন্ত্রন করতে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধ শ্রেষ্ঠীকে নির্দিষ্ট ভিক্ষু প্রবরদের নিমন্ত্রন করতে বললেন। শ্রেষ্ঠ তাঁদের নিকট গিয়ে দেখতে পেলেন যে, কোন কোন ভিক্ষু মাটিতে আঁচর কাটছেন। কেউ বা গাছের ডাল দোলাচ্ছেন আবার কেউ বা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। এতে শ্রেষ্ঠীর মনে ভিক্ষুগণ ক্ষীনাস্রব কিনা সন্দেহের সঞ্চার হয়। বৃদ্ধ শ্রেষ্ঠীর অবস্থা বুঝে বললেন-উক্ত ভিক্ষু ক্ষীনাস্রব পূর্ব জন্মের তাঁরা কেউ বা নক্ষত্রবিদ, কেউ বা বানর, আবার কেউ বা কেঁচো ছিলেন বলে সংস্কার বশে সেরূপ স্বভাব ব্যক্ত করছিলেন। প্রকৃত পক্ষে তাঁরা সবাই অরহত।

ঙ) দেবপুত্র মার ঃ দেবপুত্র পরিনির্মিত বশবর্তী দেবলোকে বাস করে। এ দেবপুত্র মার অলৌকিক শক্তির দ্বারা বিভিন্ন  রূপ ধ্বংস করে। কোন সত্ত্বই যাতে কামলোকের উর্ধ্বে যেতে না পারে সেজন্য তার অকুশল শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। এ দেবপুত্র মার যাতে সত্ত্বগণ কামলোকের নাগালের বাইরে গিয়ে নির্বাণ লাভ করতে না পারে সেই জন্য সে চির প্রতিদ্বন্ধী রূপে সাধকদের সাধনার পথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে।

সিদ্ধার্থ যখন বজ্রাসনে বসে বজ্রাধিষ্ঠান করে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হন, তখন দেবপুত্র মার গিরিমেখলা হস্তিরাজের পৃষ্ঠে আরোহন করে সহস্র সৈন্য নিয়ে তাঁকে আক্রমন করেছিলেন। সারারাত ভীষণ সংগ্রাম চালিয়ে সিদ্ধার্থ এক চূল প্রমাণ স্থানও চ্যূত করতে পারেননি। দান ও ধর্মের প্রভাবে সিদ্ধার্থ সসৈন্য মার রাজাকে পরাভূত করে দূলর্ভ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন।
এ দেবপুত্র মার সম্রাট অশোকের ৮৪০০০ হাজার চৈত্য উৎসর্গের সময় প্রবল শিলাবৃষ্টি ও ঝড় সৃষ্টি করে। তখন অর্হৎ ভিক্ষুগণ বুঝতে পারলেন এবং মার দমনের জন্য অর্হৎ উপগুপ্তকে নির্বাচন করলেন। উপগুপ্ত ও বিভিন্ন প্রকার ঋদ্ধির সাহায্যে মারের উপদ্রব বন্ধ করেছিলেন। অর্হৎ উপগুপ্ত চিন্তা করলেন এ দেবপুত্র মার অত্যন্ত ধূর্ত। তাকে সম্পূর্ণরূপে দমন করতে না পারলে ধর্ম সংগীতিতে বিভিন্ন অন্তরায় ও বাধা সৃষ্টি করবে। তখন অর্হৎ উপগুপ্ত ঋদ্ধি শক্তির প্রভাবে মারকে বন্দি করে গলা একটা পঁচা কুকুর বেঁধে পাহাড়ের গুহায় ফেলে রাখেন। তখন মার অত্যন্ত দুঃখ করে বলল আমি সম্যক সম্বুদ্ধকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তবুও তিনি কোন দিন এরূপ কষ্ট দেননি। মানুষের আয়ু অপেক্ষা আমার আয়ু অনেক বেশি। অর্হৎ উপগুপ্তের মৃতে্যুর পর আমার প্রভাব সর্বত্র বি¯তৃত করব। অর্হৎ উপগুপ্ত মারের এরূপ দাম্ভিকতা শ্রবণ করে তিনি বুদ্ধের শাসনের আয়ুষ্কাল যতদিন থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সংকল্প করলেন। এদিকে নাগরাজ অর্হৎ উপগুপ্তের আয়ু বৃদ্ধির কথা জানতে পেরে তাঁকে নাগলোকে নিয়ে গেলেন। অর্হৎ উপগুপ্ত বর্তমানে নাগলোকে বাস করছেন।

উপসংহার ঃ এই পৃথিবীতে মানুষ ত্রিতাপে দগ্ধ হচ্ছে। ত্রিতাপে দগ্ধ হয়ে মানুষ জন্মান্তর  কাল ধরে দুঃখ ভোগ করছে। দুঃখ সাগরে নিমজ্জিত হয়ে মানুষ মুক্তির পথ খোঁজে পায় না। যাঁরা মুক্তির সন্ধানে সাধনার পথে অগ্রসর হচ্ছেন, মার তাঁদেরকে নিজ অধীনে আনার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। যাঁরা বীর্যবান নয় তাঁরা মারের প্রভাবে পড়ে সংসারের বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করে নিজেই নারকীয় দুঃখ ভোগে। তাই মারের প্রভাব হতে মুক্তি লাভ করতে হলে মানুষকে প্রজ্ঞাবান হতে হবে। স্বীয় বীর্য বলে মারের প্রভাবের গন্ডীর বাইরে গিয়ে জীবনকে সার্থক করতে হবে। অন্যথায় মানব জীবন লাভ বৃথাই পর্যবসিত হবে।
অতএব, আত্মশুদ্ধি ও আত্মমুক্তির জন্য মারের প্রভাব হতে নিজ নিজকে মুক্ত রাখার জন্য চেষ্টা করা সকলেরই কর্তব্য।


লেখকঃ সাধারণ সম্পাদক, পূর্বগুজরা বৌদ্ধ ভিক্ষু সম্মিলনী, সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভা।

0 comments:

“শান্তি চাই”

“শান্তি চাই”
মহামান্য মহাসংঘনায়ক শ্রীসদ্ধর্মভাণক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের


বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস নানা ঘটনা ও বিবর্তনের ইতিহাস। অগ্রগতি যেমন অভাবনীয় অবক্ষয়ও তেমনি অচিন্তনীয়। একদিকে দারুণ আনন্দ উল্লাস অন্যদিকে করুন হাহাকার। তাই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে অস্থিরতা। লোভ আর প্রতিহিংসার তীক্ষè জালে আবদ্ধ নর-নারী। পর-রাজ্য লোভ, আত্মপ্রতিষ্ঠা আর সম্পত্তির লোভ মানুষকে করেছে স্বার্থপর। এই অবস্থায় শান্তি নামক শব্দটি বহু দূরে নির্বাসিত। অথচ পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে শান্তি চাই। শান্তি কি সুদূর পরাহত? না, শান্তি অকল্পনীয় কোন বস্তু নহে। আজ বিশ্বে শান্তির জন্য হাহাকার উঠেছে। বিশ্বের সমগ্র মানুষ উঠেছে আধুনিক বিলাস ব্যাসনে আর যান্ত্রিক সভ্যতায় বন্দীদশায় এ সময়ে দরকার একটু স্বস্তি, একটু শান্তি। 
এই শান্তি কি ভাবে আসতে পারে। আমরা যারা ধর্মীয় আচার্যরা আছি আমাদের প্রত্যেকের এই ব্যাপারে একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে বলে মনে করি। এ যাবৎ সর্ব ধর্মের যত সম্মেলনে গেছি সর্বত্রই একটি কথা বলেছি যে আমাদের সকলের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। সকল ধর্মের মর্মবাণীগুলিকে সন্নিবেশিত করে তাকে মানব কল্যাণে উৎসাহিত করা দরকার। আমি আহ্বান জানিয়েছি সকল ধর্মের আচার্যদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে একই টেবিলে বসে আহার করার জন্য একই লক্ষ্য চিন্তা করার জন্য এবং একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করার জন্য, আমার বিশ্বাস সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তখনই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বিভিন্ন ধর্মের লোক স্ব-স্ব ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত বলে বেড়াচ্ছে নিজেরটায় শ্রেষ্ঠ ধর্ম তাই অপর ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা জাগছে না, সে অপর ধর্মালম্বীদের প্রতি সহনশীল হতে পারছে না। ক্রমাগত দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে এতদ্বারা ধর্মীয় রেষারেষি বাড়ছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। সেজন্য পরস্পরকে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে হবে প্রত্যেককে সকল ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে হবে। শিশুকে সকল ধর্মের প্রতি বাল্যকাল থেকে জ্ঞান দান করতে হবে। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন ধর্মের কল্যাণময় বাণীগুলি থাকা দরকার। এছাড়া বিভিন্ন ধর্ম প্রচারক সম্পর্কেও পরিচিতি প্রয়োজন। এভাবে আমরা শিশুদের আগামীকালের উদাত্ত সহনশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে পারি। দুঃখের কথা পৃথিবীতে ধর্মযুদ্ধে যত মানুষ মারা যাচ্ছে ধর্মের রেষারেষিতে যত জীবন বিনষ্ট হচ্ছে যুদ্ধে তত জীবন বিনষ্ট হচ্ছে না। অথচ ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণে, বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায়। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের চিন্তাকে জাগ্রত করা প্রয়োজন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান যে যেই ধর্মালম্বী হোক না কেন আমাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণ। কোন ধর্মে হত্যা, চুরি, মিথ্যা, ব্যভিচার, মদ্যপান স্বীকৃত নহে, অতএব, আমরা যদি স্ব-স্ব ধর্মের বাণীগুলি পরিপূর্ণভাবে মেনে চলি তবে অশান্তির কোন কারণ থাকতে পারে না। বৌদ্ধ হিন্দু যদি হযরত মুহাম্মদকে, খৃষ্টান যদি কৃষ্ণকে, মুসলমান যদি বুদ্ধকে ভালবাসতে পারে, শ্রদ্ধা জানাতে পারে তবে আর ধর্মের জন্য যুদ্ধ হবে না। সাম্প্রদায়িক বাড়বে না। ধর্মে ধর্মে বিরোধ হবে না। মানুষ যদি প্রকৃতভাবে নিজের ধর্মের গুণাবলীগুলি বুঝতে পারে তবে সে অন্য ধর্মের প্রতি অসহনশীল হবে না এবং হতে পারে না। 
অতএব, আসুন আমরা একে অপরকে ভালবাসি। একে অপরকে গ্রহণ করি। এই ভালবাসা হউক শান্তির সুদূঢ় স্তম্ভ-এই গ্রহণ হোক লক্ষপ্রীতির ভিত্তি ভূমি। সেজন্য প্রত্যয়ের সাথে বলতে চাই। শান্তি প্রয়োজন এবং আমরা শান্তি চাই। এই কামনা হোক আমাদের অন্তরের এই প্রতিষ্ঠা হোক সর্বজনীন সাম্যের সত্যেরও শান্তির। 

সংগ্রহ : নির্বাণ পত্রিকা বৈশাখী পূর্ণিমা সংখ্যা-১২ মে ১৯৮৭ ইং।

0 comments: